বাচনিক যুক্তিবিদ্যা

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-বাচনিক যুক্তিবিদ্যা

বাচনিক যুক্তিবিদ্যা

বাচনিক যুক্তিবিদ্যা বচনসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। বাচনিক যুক্তিবিদ্যাকে অনেকে ভাষার অর্থ বিশ্লেষণে নিয়োগ করে থাকেন। তবে এটি কিভাবে বাগর্থের সাথে যুক্ত তা বোঝার জন্য যৌক্তিক থাকা তত্ত্বের সাথে পরিচিত হতে হবে।

রুডলফ কারন্যাপ যৌক্তিক বাক্যতত্ত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “কোন ভাষার যৌক্তিক বাক্যতত্ত্ব বলতে আমরা বুঝি সেই ভাষার ভাষিক রূপের রৌপিক তত্ত্ব ভাষার নিয়ন্ত্রণকারী রৌপিক নিয়মের সুশৃঙ্খল বর্ণনা এবং তার সাথে ঐ সমস্ত নিয়ম প্রয়োগ করলে যে ফলাফল পাওয়া যায় তার অভিব্যক্তি।”(Barhillel 1964 : 38) যৌক্তিক বাক্যতত্ত্বের কাজ ৰচন নিয়ে যা যুক্তিবিদ্যার মৌলিক একক ।

একটি বচন আরেকটি বচনের সাথে সম্পর্কিত হয় যেক্তির সংযোজক বা যৌক্তিক চালকের মাধ্যমে। নীচে কয়েক ধরনের যৌক্তিক চালকের নাম উল্লেখ করা হলো যার কয়েকটির সাথে ইতোমধ্যে আমাদের পরিচয়

প্রতীক

A &

4& বা

নাম

সংযুক্তি

নেতিবাচকতা

ইঙ্গিত

সমতুল্যতা

বাংলারপ

(এবং) তা (যদি তবে)

(অথবা)

(যদি তবে

(যদি এবং কেবল যদি … তবে

এখন উপরোক্ত যৌক্তিক চালকসমূহ ব্যবহার করে আমরা বিভিন্নভাবে বচন সংযুক্ত করতে সক্ষম। আমরা বচনসমূহকে বাংলায় ৪. এ. ক্ষ দিয়ে চিহ্নিত করবো (ইংরেজীতে এক্ষেত্রে pr. q ব্যবহৃত হয় ) । যেমন

তিনি ধনী এবং তিনি সুখী

তিনি ধনী অথবা তিনি সুধী

তিনি ধনী এবং তিনি সুখী ন

তিনি যদি ধনী হন তবে তিনি সুখী

তিন সুধী যদি এবং কেবল যদি তিনি ধনী

তিনি ধনী এবং সুখী এ

তিনি ধনী এবং সূখী অথবা

তিনি ধনী অথবা সুদী এবং

তিনি ধনী কিন্তু অসুখী ও অসৎ

একটি বচন সত্য অথবা মিথ্যা হতে পারে। বচনের সত্য বা মিথ্যা হওয়াকে বলে সভ্যমূল্য যৌগিক বচন T সত্য না মিথ্যা তা নির্ভর করে সরল বচনগুলির সত্য বা মিথ্যা হওয়ার উপর। সরল বচন ও যৌগিক বচনের মধ্যে সত্যমূল্যের সম্পর্ক তালিকার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়।

এ ধরনের তালিকাকে বলা হয় সত্য সারণী । ইংরেজীতে সত্যকে এবং মিথ্যাকে f দিয়ে লেখা হয়। আমরা বাংলায় সত্যকে স মিথ্যাসে ম দ্বারা চিহ্নিত করবো। একটি বচন একইসাথে সত্য ও মিথ্যা হতে পারে না। যেমন তিনি সৎ এটি হয় সত্য না হয় মিথ্যা হবে কিন্তু একইসাথে সত্য কিংবা মিথ্যা হবে না।

অন্যভাবে বলা যায় তিনি গং এটি মিথ্যা হলে তিনি অসৎ এটি সত্য হবে । এটি নেতিবাচকতার নিয়ম। একটি ইতিবাচক বচন এবং তার বিপরীতে ডাকটি নেতিবাচক বচনের মধ্যে সম্পর্ককে একটি ছোট সত্য সারণীর মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় :

 

বাচনিক যুক্তিবিদ্যা

 

কাজেই সংযুক্তির ক্ষেত্রে উক্ত বচন সত্য হলে যৌগিক কনটি সত্য এবং উভয় বচন মিথ্যা হলে যৌগিক বচনটি মিথ্যা হবে, কিন্তু দুটির একটি সত্য ও একটি মিথ্যা হলে যৌগিক বচনটি মিথ্যা হবে। আমরা উদাহরণ সরবরাহ করতে পারি

তিনি শিক্ষিত (সত্য)

তিনি সত্যবাদী (সত্য)

.. তিনি শিক্ষিত ও সত্যবাদী (সত্য)

তিনি শিক্ষিত (সত্য)

তিনি সত্যবাদী (মিথ্যা)

তিনি শিক্ষিত ও সত্যবাদী (মিথ্যা)

তিনি শিক্ষিত (মিথ্যা)

তিনি সত্যবাদী (সত্য)

– তিনি শিক্ষিত ও সত্যবাদী (মিথ্যা)

তিনি শিক্ষিত (মিথ্যা)

তিনি সত্যবাদী (মিথ্যা)

. তিনি শিক্ষিত ও সত্যবাদী (মিথ্যা)

বিযুক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায় দুটি বচনের উভয়টি সত্য অথবা একটি সত্য ও একটি মিথ্যা হলে যৌগিক বচনটি সত্য

এবং উভয় বচন মিথ্যা হলে যৌগিক বচনটি মিথ্যা হয় ।

তিনি শিক্ষিত (সত্য)

তিনি সত্যবাদী (সত্য)

… তিনি শিক্ষিত অথবা সত্যবাদী (সত্য

তিনি শিক্ষিত (সত্য)

তিনি সত্যবাদী (মিথ্যা)

তিনি শিক্ষিত অথবা সত্যবাদী (সভা)

তিনি শিক্ষিত (মিথ্যা)

তিনি সত্যবাদী (সত্য) . তিনি শিক্ষিত অথবা সত্যবাদী (সত্য)

তিনি শিক্ষিত (মিথ্যা)

তিনি সত্যবাদী (মিথ্যা)

. তিনি শিক্ষিত অথবা সত্যবাদী (মিথ্যা)

এখানে একটি ব্যাপার বলা প্রয়োজন যে যুক্তিবিদ্যার অথবা এবং সাধারণ ভাষার একবার মধ্যে প্রায়ই পার্থক্য দেখা দেয়। যুক্তিবিদ্যার অথবা কে বলা হয় অন্তভূতিমূলক অথবা যা বহির্ভূক্তিমূলক অথবা থেকে পৃথক । বহির্ভূক্তিমূলক অথবা র উদাহরণ হলো:

তিনি শিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত তিনি সত্যবাদী অথবা মিথ্যাবাদী

এগুলোকে হয় … নায়/ নতুবা সংযোজক দিয়ে প্রকাশ করা যায়। যেমন : নয়/নতুবা

হয় তিনি শিক্ষিত নতুবা অশিক্ষিত হয় তিনি সত্যবাদী নয় মিথ্যাবাদী ।

এধরনের যৌগিক বচনের সাথে সরল বচনের সম্পর্ক অবিকল আমাদের সত্য সারণীর মতো নয়। যেমন, তিনি শিক্ষিত এবং তিনি অশিক্ষিত এর একটি সত্য এবং একটি মিথ্যা হলে তিনি শিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত সত্য হবে। কিছু আমাদের সারণীতে এরূপ ক্ষেত্রে যৌগিক বচনটি মিথ্যা হয়।

এই পার্থক্যের কারন হলো অঞ্চ বিভাজন । বহির্ভূক্তিমূলক বিমুক্তির ক্ষেত্রে সরল বচনগুলোর অথয়া সম্পূর্ণরূপে পৃথক থাকে, কিছু অন্তর্ভূক্তিমূলক বিযুক্তির ক্ষেত্রে অঞ্চলদুটি পরস্পরকে অধিক্রমন করে। এজন্য প্রথম ক্ষেত্রে কেউ সত্যবাণী হলে তাকে আর মিথ্যাবাদী হওয়া সম্ভব না, কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে একজনের পক্ষে একইসাথে শিক্ষিত ও সত্যবাদী হওয়া সম্ভব। বহির্ভূক্তিমূলক বিযুক্তি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিযুক্তিকে চিত্রের সাহায্যে দেখানো যায় :

এবার ইঙ্গিতের প্রসঙ্গে আসা যাক। ইঙ্গিতের ক্ষেত্রে একটি বচন থেকে যৌক্তিকভাবে আরেকটি বচন নিঃসৃত হয়। ইঙ্গিতের সত্যসারণীটি এরকম:

 

বাচনিক যুক্তিবিদ্যা

 

এখানে দেখা যায় সত্য বচন থেকে কেবল সত্য বচন, কিন্তু মিথ্যা বচন থেকে সত্য বচন ও মিথ্যা বচন হওয়াই যৌক্তিকভাবে নিঃসৃত হতে পারে। উদাহরণ দেয়া যেতে পারে

গরু চতুষ্পদ (সত্য)

মানুষ বিপদ (সত্য)

গরু যদি চতু পদ হয় তবে মানুষ দিপন (সত্য)

গরু চতুষ্পদ (সত্য)

মানুষ চতুষ্পদ (মিথ্যা) গরু যদি চতুষ্পদ হয় তবে মানুষ চতুষ্পদ (মিথ্যা)

গরু বিপদ (মিথ্যা)

মানুষ রিপন (সত্য) গরু যদি দ্বিপদ হয় হবে মানুষ বিপদ (সত্য)

গরু বিপদ (মিথ্যা)

মানুষ চতুষ্পদ (মিথ্যা) পরু যদি পিন হয় তবে মানুষ চতুষ্পদ (সত্য)

এখানে ব্যাপারটি একটু গোলমেলে মনে হতে পারে। মিথ্যা বচন থেকে যদি সত্য ও মিথ্যা উভয় বচন নিঃসৃত হয়

তাহলে নীচের বাক্যদুটি সত্য হবে :

আমি যদি অদৃশ্য হই তবে কেউ আমাকে দেখতে পারে না । আমি যদি অদৃশ্য হই তবে সবাই আমাকে দেখতে পাবে ।

এরকম আপাত অসাম্যাসোর কারণ হলো যুক্তিবিদ্যার ইঙ্গিতটি পদার্থমূলক ইঙ্গিত যা সাধারণ ভাষার কড়াকড়ি ইঙ্গিত থেকে ভিন্ন । পদার্থমূলক ইঙ্গিতে দুটি বচনের মধ্যে একটি যান্ত্রিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, অন্যদিকে কড়াকড়ি ইঙ্গিতে দুটি বচনের মধ্যে একটি আন্তর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় ।

এবার আমরা সমতুল্যতার সত্যসারণী নির্মান করতে পারি :

 

বাচনিক যুক্তিবিদ্যা

 

সাধারণভাবে বলতে গেলে সমতুল্যতা হলো দুটি ইঙ্গিতের সংযুক্তি। যেমন ও = ঞ এর মানে হলো (ঙ⇒ ঞ) ^ (ঞ)। সাধারণ ভাষা থেকে উদাহরণ দিয়ে বলা যায় :

যদি আবুল বাবুলের বন্ধু হয় এবং বাবুল আবুলের বন্ধু হয় তবে আবুল এবং বাবুল সমতুল্য (অর্থাৎ তারা পরস্পরের বন্ধু) সমতুল্যতার সাথে সংযুক্তি ও বিযুক্তির মতো নেতিবাচকতার একটি সম্পর্ক রয়েছে । তাদের মধ্যে মিথক্রিয়ার একটি রূপ হলো :

বক লাল হলে কাক কালো = বক লাল নয় অথবা কাল কালো = বক লাল এবং কাক কালো
এর কোনটাই নয়।

(~~ V9)~ = (10) ^ 9~) = (159)

জেফ্রি লীচ (১১৯৮১ ১৬৬ ১৬৭) যৌক্তিক চালকের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে প্রজ্ঞাপন, অনুলাপ, ও রবিরোধের ব্যাখ্যা দেন ।

প্রজ্ঞাপন : প্রজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে একটি বচন সত্য হলে তার থেকে অনুমিত বচনটি অবশ্যই সত্য হবে । যেমন, খালেদ বই পড়ে যদি সত্য হয় তবে খালেদ পড়ে অবশ্যই সত্য। এক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় বচনটিকে ইঙ্গিতের মাধ্যমে প্রকাশ করা

অনুলাপ : অনুসাপের ক্ষেত্রে একটি বচনের পুনরাবৃত্তি ঘটে। যেমন, যদি বরফ শীতল হয় তবে তা পরম নয় বচনটি বরফ শীতল এই বচনের অনুলাপ। অনুলাপকে এভাবে দেখানো যায়যদি এরস্ববিরোধ স্ববিরোধের ক্ষেত্রে দুটি বচন বিপরীত সত্য নির্দেশ করে। যেমন, বরফ শীতল এবং বরফ গরম স্ববিরোধী। যদিও কোন বচন হয় তবে তার সাথে -৫ এর সংযুক্তি স্ববিরোধী হবে। যেমন :

আকাশ নীল এবং আকাশ নীল নয় ।

এভাবেই দার্শনিকগণ বাচনিক যুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে বিভিন্ন বাগার্থিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের প্রয়াস পান যৌক্তিক চালকের গুরুত্ব সম্পর্কে লীচ (১৯৮১ : ১৮৩) বলেন :
“এই উপকরণগুলি মানুষের চিন্তাশক্তিকে ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তোলে কারণ এগুলোর মাধ্যমেই আমরা প্রকাশ্যভাবে বাগর্থিক বিষয়ের সম্পর্ক ও শ্রেণীসমূহকে কার্যে নিয়োজিত করি সেগুলো কেবল আমাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনাতেই সক্ষম করে তোলে না বরং সত্যের নিয়ন্ত্রণমূলক ধারণার মাধ্যমে অভিজ্ঞতার প্রমাণাদিকে মূল্যায়ন, সে সম্পর্কে যুক্তিনির্মান এবং তা থেকে সিদ্ধান্ত অনুমানে সক্ষম করে তোলে । বলতে গেলে সেগুলো হলো রাগথিক সংস্রয়ের নিয়ামক উপকরণ ।

আরও দেখুন:

 

Leave a Comment