আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়ন কৌশল – যা আরবি ভাষা ও সাহিত্য পাঠদানে শ্রেণিকক্ষ পরিচালনা ও শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়ন এর অন্তর্ভুক্ত।
শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়ন কৌশল

আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের শিখনের অন্যতম প্রধান একটি মাধ্যম হচ্ছে শ্রেণিকক্ষ। এ শ্রেণিকক্ষ আবার শিক্ষকের জন্য অজস্র অভিজ্ঞতারও উৎস। শিক্ষকতা পেশার উন্নয়নে শিক্ষকের জন্য পুস্তকের তাত্ত্বিক জ্ঞানের চেয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান সব সময়েই বাস্তবমূখী ও তাৎপর্যপূর্ণ। শ্রেণিকক্ষের বাস্তব অভিজ্ঞতা একজন শিক্ষককে বিশেষত শিখন-শেখানো বিষয়ে তার অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিতে পারে। শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সর্বোত্তম পন্থায় একজন শিক্ষকতার পেশাগত উন্নয়ন সাধন করতে পারেন।
পেশাগত জীবনে একজন শিক্ষকের জন্য আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় পেশাগত উন্নয়নে মনোনিবেশ করার সময় ও সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। তাই তখন অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তাঁকে তার পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়ন ঘটাতে হয়। জ্ঞানের বিবর্তন, সামাজিক পরিবর্তন, প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে তাল রেখে বর্তমানে শিক্ষকতা তথা শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম একটি পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়ার রুপ পরিগ্রহ করছে। শিক্ষণ এখন আর কোন স্থির পেশা নয় ।
শিক্ষককে বলা হয় পরিবর্তনের প্রতিনিধি (Change Agent)। পরিবর্তনের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁকে নিরন্তর পরিবর্তিত শিক্ষণ দক্ষতার অনুসন্ধান করতে হয়। শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়ন বলতে তার কর্মবিষয়ক বা পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়নকে বোঝায়। শিক্ষকতা পেশার কর্মপরিধি ব্যাপক হলেও একজন শিক্ষকের মূল কাজ শ্রেণিকক্ষে। সে হিসেবে শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়ন বলতে প্রথমত শ্রেণিকক্ষে কার্যকর ও ফলপ্রসূ শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম আঞ্জাম দেওয়ার দক্ষতা অর্জনকে বোঝায়। এ অধিবেশনে শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়নের ধারণা, শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতা থেকে আত্ম-উন্নয়ন কৌশল সম্পর্কে আলোক পাত করা হল।
শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়ন/পেশাগত উন্নয়ন এর ধারণা
শিক্ষকতাকে ‘ব্রত’ কিংবা ‘মহানপেশা’- যে হিসেবেই গণ্য করা হোক না কেন, এ মহান দায়িত্বের সুন্দর সার্থক ও প্রত্যাশিত আঞ্জাম দেয়ার জন্য সবার আগে শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়ন অত্যাবশ্যক। শিক্ষকদের আত্ম-উন্নয়ন বা পেশাগত উন্নয়নের উপায় সম্পর্কে আলোকপাতের পূর্বে প্রসঙ্গত আত্ম-উন্নয়ন/পেশাগত উন্নয়ন বলতে কী বুঝায় বা আত্ম-উন্নয়নের স্বরূপ বা প্রকৃতি সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা প্রয়োজন। শিক্ষকতাকে যদি পেশা হিসেবেও বিবেচনা করা হয় তাহলেও একজন শিক্ষককে দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়।
আর সে সংগ্রাম হলো উৎকর্ষের সংগ্রাম। অর্থাৎ এ পেশার কার্যক্রমের উৎকর্ষ সাধনের জন্য তাকে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। যেমন বলা হয়েছে “Teaching is a vocation rather than a profession, no matter, if you consider it as a profession, you must go under a long time strive, strive for excellence”.
সাধারণত উন্নয়ন বলতে বর্তমান অবস্থার কাঙ্খিত পরিবর্তনকে বোঝানো হয়। অর্থাৎ উন্নয়ন হল পরিবর্তন, কোন কিছুকে প্রত্যাশিত মানে উন্নীতকরণ, অবস্থার চাহিদা মতো পরিবর্তন সাধন ইত্যাদি। জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রদত্ত পেশাগত কৌশল ও দক্ষতাবৃদ্ধি এবং তার প্রয়োগই হল পেশাগত উন্নয়ন। অন্যভাবে বলা যায়, ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের পেশার সুনাম, সুখ্যাতি বৃদ্ধির তাগিদে নিজ স্বকর্ম দক্ষতা বৃদ্ধি করে বর্তমান পেশার কাঙ্খিত উন্নয়ন করার প্রক্রিয়াকেই পেশাগত উন্নয়ন বলে ।
দিয়েছে, তার সার কথা হলো- পেশাগত বিষয়ে নতুন জ্ঞানের অন্বেষণ করা, ভাবনা-চিন্তা করা এবং নিজের আচরণ উন্নত করা, নিজের জ্ঞান গভীর রাখা এবং অ্যাকাডেমিক পাঠ্য বিষয় বা বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম সম্পর্কে নিজেকে অনুসন্ধিৎসু রাখা। শিক্ষার্থী এবং তাদের শিক্ষা বিষয়ে গবেষণা করা এবং সেগুলো প্রতিফলিত করা, শিক্ষা ও সামাজিক বিষয় বোঝা ও নিজেকে অনুসন্ধিৎসু করা, বৌদ্ধিক বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে ওঠা এবং সেই ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টি ভাগাভাগি করা ইত্যাদি।
শিক্ষকদের পেশাগত শিখন বা উন্নয়ন তাদের নিজেদের কাজ বা আচরণ সম্পর্কিত জ্ঞান, দক্ষতা অর্জন করতে সহয়তা করে। পেশাগত উন্নয়ন হল শিক্ষকের সক্ষমতা বাড়ানোর উপায়। শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়ন বলতে তার পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়নকে বুঝায়। আবার শিক্ষকের ক্ষেত্রে পেশাগত উন্নয়ন বলতে সবার আগে শ্রেণিকক্ষে শিখন-শেখানোর দক্ষতাকে বুঝানো হয়। তাই শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়ন কথাটির দ্বারা শিখন- শেখানো কাজে শিক্ষকের সামর্থ্য বৃদ্ধি বা প্রত্যাশিত দক্ষতা অর্জনকে বোঝায় ।
আসুন বন্ধুরা, আমরা এখন নিচের উক্তিটি মূল্যায়নে আমাদের অভিমত লিখি । শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতা হতে পারে একজন শিক্ষকের শিখন-শেখানো কার্যক্রম উন্নয়নের মূলভিত্তি। কারণ-
১.
২.
৩.
8.
৫.
শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতা থেকে আত্ম-উন্নয়নের উপায়
শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়নের নানাদিক ও ক্ষেত্র রয়েছে। শ্রেণিকক্ষে শিখন-শেখানো কার্যক্রম কার্যকর ও নৈপুণ্যের সাথে আঞ্জাম দেওয়া একজন শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব। এ জন্য শ্রেণিকক্ষের শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম ও পরিস্থিতির উন্নয়ন শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়নের প্রথম অগ্রাধিকার। শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়নের নানা উপায় রয়েছে। শিক্ষকের জন্য শ্রেণিকক্ষের অভিজ্ঞতার জগৎ সুবিস্তৃত। বিশেষত প্রতিফলনমূলক চিন্তার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষের নানা বিষয়কে সামনে এনে তা পর্যালোচনা করে একজন শিক্ষক নিজেকে পরিবর্তন করতে পারেন।
শিখন-শেখানো কলাকৌশল ও পদ্ধতি, শিখন পরিবেশ, শিক্ষার্থীর শিখন প্রতিবন্ধকতা, শিখন চাহিদা, শিখন ভীতি, অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের আচরণ, শিখনে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ, শ্রেণিকক্ষের কাজ ব্যবস্থাপনা, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সাড়াদান, শিখনফল অর্জন ইত্যাদি’র অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন করে নির্ধারণ করতে পারেন নিজের কর্মপন্থা, আনতে পারেন ব্যবহৃত শিক্ষণ কৌশল ও কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন। আত্ম- উন্নয়নে একজন শিক্ষক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন, তন্মধ্যে নিম্নোক্ত কৌশলসমূহ অন্যতম । যেমন-
- সেলফ মনিটরিং বা আত্ম-অবলোকন;
- শিক্ষার্থীদের ফলাবর্তন/ফিডব্যাক সংগ্রহ; অন্য সহকর্মী শিক্ষকদের অনুসরণ/পর্যবেক্ষণ;
- প্রতিফলনমূলক চিন্তা,আত্ম-প্রতিফলন ও প্রতিফলন অনুশীলন;
- নিজের কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি ও উৎকর্ষের সাধনা; • সামাজিক মাধ্যমসমূহের (Social Media) ব্যবহার;
- পেশাগত অধ্যয়ন/পঠন;
- কর্মোন্নয়ন/কর্মসহায়ক গবেষণা (Action Research);
- পাঠের অডিও ভিডিও রেকর্ড পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও আত্ম-সংশোধন ইত্যাদি ।
ক. সেলফ মনিটরিং বা আত্ম-অবলোকন
আক্ষরিকভাবে আত্ম-অবলোকন অর্থ নিজকে দেখা। অর্থাৎ নিজের আচার-আচরণ, কার্যকলাপ নিজেই পর্যবেক্ষণে রাখা। আত্ম-অবলোকন কথাটি সকল পেশাদার বা চর্চাকারীর (Practitioner) ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শিক্ষকের ক্ষেত্রে আত্ম-অবলোকন হচ্ছে এমন একটি কৌশল, যার মাধ্যমে একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে তার নিজের শিক্ষণ আচরণসহ তার কর্ম বা পেশা সংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রমের আত্ম-মূল্যায়নপূর্বক তার প্রমাণ সংরক্ষণ করেন। আত্ম-অবলোকনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সংশোধন ও উন্নয়ন।
তাই আত্ম-অবলোকন একটি আত্ম- উন্নয়ন প্রক্রিয়া। আত্ম-বীক্ষণের মাধ্যমে নিজের কর্মদক্ষতা কিংবা কার্যক্রমের মান নির্ণয় শিক্ষক নিজেই করেন। এ প্রক্রিয়ায় কাঠামোগত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একজন শিক্ষক তার পেশাগত কার্যক্রমের উন্নয়ন সাধন করতে পারেন। এর মাধ্যমে শিক্ষক তার ব্যক্তিগত আচরণ ও শিক্ষক হিসেবে শিক্ষণ আচরণের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে পারেন এবং ব্যক্তিগত আচরণ ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হতে পারেন। অর্থাৎ কোন কোন বিষয়ে নিজের আচরণের উপর নিয়ন্ত্রণ, সংশোধন বা পরিশীলন করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে সচেতনতা লাভ করতে পারেন।
ব্যক্তিগত মনিটরিং বা অবলোকনের জন্য একজন শিক্ষককে তাঁর পাঠ সংক্রান্ত তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করতে হয়। এ তথ্য লিপিবদ্ধের কাজটি একাধিকভাবে হতে পারে। যেমন- পাঠদান সংক্রান্ত লিখিত রেকর্ড, অডিও, ভিডিও, ফলাবর্তন ইত্যাদি।

অর্থাৎ উন্নয়ন প্রত্যাশী শিক্ষক তাঁর শিক্ষণ আচরণসহ সমুদয় কার্যক্রমের ব্যাপারে শিক্ষার্থী, কো-টিচার, সহকর্মী এবং তাঁর তত্ত্বাবধায়কের নিকট থেকে ফিডব্যাক/ফলাবর্তন নিবেন এবং এসবের ভিত্তিতে আত্ম-উন্নয়নে সচেষ্ট হবেন। শিক্ষাবিদ লাফটখভঃ (১৯৬৯) ব্যক্তিগত মনিটরিং বা আত্ম-অবলোকন প্রশ্নে শিক্ষকের শিক্ষণ আচরণকে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেন আর সে ক্যাটাগরিগুলোকে তিনি নামকরণ করেছেন এভাবে-
- Information concerning the “open-self”
- Information concerning the “secret-self”
- Information concerning the “blind-self” and
- Information concerning the “undiscovered/hidden self”.
Information concerning the Open-Self”, এখানে ”Open-Self” বলতে তিনি একজন শিক্ষকের
ঐসব আচরণকে বুঝিয়েছেন যেগুলো সম্পর্কে স্বয়ং তিনি নিজেই জ্ঞাত এবং তার শিক্ষার্থী এবং অন্যান্য সহকর্মী অবগত। এ ‘ওপেন সেলফ’ দিকটি নিয়ে একজন শিক্ষক অন্যের সাথে আলোচনা করতে পারেন।
Information concerning the “Secret-Self”: শিক্ষণ আচরণের আরেকটি দিক, যাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে Information concerning the “Secret – Self” হিসেবে। সিক্রেট সেলফ বা গোপন দিক হচ্ছে শিক্ষকের শিক্ষণ আচরণের সেই সবদিক যেসব বিষয়ে শিক্ষক নিজে জানেন কিন্তু শিক্ষার্থী, সহকর্মী কিংবা অন্যেরা অবগত নয়।
উদাহরণস্বরূপ- শিক্ষককে সবার সামনে বিশেষ কোন বিষয়ে শিক্ষণ-শিখন অধিবেশন পরিচালনা তথা পাঠদান করতে হবে। যে বিষটির উপর অধিবেশন পরিচালনা করতে হবে, তার কিছু কিছু বিষয় তার জানা নয়। আবার তিনি তা সবার সামনে প্রকাশ করতে পারছেন না এবং এ ব্যাপারটি অন্যদেরকে জানাতেও বিব্রত বোধ করেন। কারণ এ বিষয়টি জানা-জানি হলে তার যোগ্যতা সম্পর্কে অন্যদের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে কিংবা তিনি অযোগ্য শিক্ষক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবেন। এ সিক্রেট সেলফ বা গোপন দিকটি ব্যক্তিগত মনিটরিং বা অবলোকন এর মাধ্যমে চিহ্নিত করে উন্নয়ন করা যায়।
Information concerning ” the blind-self”: ‘দ্যা ব্লাইন্ড-সেলফ’ তথা অন্ধকার দিক টার্মটির দ্বারা শিক্ষকের শিক্ষণ আচরণের ঐদিকগুলোকে বুঝানো হয়েছে যে বিষয়গুলো একজন শিক্ষক নিজে বুঝতে পারছেন না বা তার অজান্তেই ঘটে যাচ্ছে। অন্যের চোখ তিনি এড়াতে পারছেন না অথচ নিজে ও বুঝতে পারছেন না। উদাহরণস্বরূপ- শিক্ষক পাঠ আলোচনার সময় শিক্ষার্থীদের সামনে বারংবার ‘তো-তো-তো’ শব্দটি ক্লাসে বলেই যাচ্ছেন— যা শিক্ষার্থীদের কাছে শ্রুতিকটু কিংবা বিরক্তি কর লাগছে; কিন্তু তিনি নিজে তা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না |
Information concerning the ” undiscovered/ hidden self” : দ্যা আনডিসকভারড/ দ্য হিডেন বা লুকায়িত দিক। এটি শিক্ষকের শিক্ষণ আচরণের এমন দিক বা বিষয় যা একজন শিক্ষকের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে যা শিক্ষক নিজেও জানেন না বা তার শিক্ষার্থী কিংবা অন্যরাও জানেন না বা বুঝতে পারেন না। আত্ম- অবলোকনের চর্চা না থাকলে তার এ অজানা দিকগুলো জীবনব্যাপি অজানাই থেকে যায়। আত্ম-মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সেসব দিক উদঘাটন করা সম্ভব।
সেলফ-মনিটরিং বা আত্ম-অবলোকন করার উপায়
সেলফ মনিটরিং বা আত্ম-অবলোকনের বিভিন্ন কৌশল রয়েছে। তন্মধ্যে প্রধান ৩টি কৌশল নিম্নরূপ :
১. ব্যক্তিগত বা আত্ম-প্রতিফলন;
২. আত্ম-রিপোর্টিং (Self-Reporting);
৩. পাঠের অডিও ভিডিও রেকর্ড রাখা।
আত্ম-প্রতিফলন:
শিক্ষকতা পেশায় আত্ম-প্রতিফলন হল পেশাগত চর্চা তথা শিখন-শেখানো কার্যক্রম সম্পর্কে শিক্ষকের এক ধরণের নিয়মিত আত্ম-পর্যালোচনামূলক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের শিখন-শেখানো কার্যক্রমের পূর্বাপর অভিজ্ঞতার সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে শিক্ষার্থীদের সর্বাধিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারেন। আত্ম-প্রতিফলন একজন শিক্ষককে সূক্ষ্ম মূল্যায়নের মাধ্যমে তার নিজের পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা এবং কার্যক্রম সম্পর্কে অধিক সচেতন করে।
ফিনলে (২০০৮)-এর মতে আত্ম-প্রতিফলন হলো নিজের কাজ ও চর্চা সম্পর্কে নতুন অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করা এবং অভিজ্ঞতা থেকে শেখা । শিক্ষকতা পেশায় আত্ম-প্রতিফলন থেকে শিক্ষক তার নিজেকে এবং তার শিক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, মূল্যায়ন করে তার নিজ শক্তিমত্তা ও দূর্বলতা সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন। আবার প্রতিফলন থেকেই একজন শিক্ষক তার যেসব ক্ষেত্রে উন্নয়ন করা প্রয়োজন, তা নির্ণয় করতে পারেন।
প্রতিফলন কাজে প্রতিফলন ডায়েরি ব্যবহার করতে হয়। যেমন পাঠদানের অব্যবহিত পরেই একজন শিক্ষক শ্রেণি পাঠদানের অভিজ্ঞতার বিভিন্ন দিক তার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করবেন। শ্রেণিকক্ষে যা যা ঘটেছে এবং শিক্ষকের ব্যক্তিগত অনুভুতি ও প্রতিক্রিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লিপিবদ্ধ করবেন। এ সব অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন নতুন কর্মনীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন- যা একাধারে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের চর্চায় অগ্রগতি সাধন করবে। প্রতিফলন একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া, তাই ইহা ‘প্রতিফলন অনুশীলন নামে আখ্যায়িত। পরবর্তী অধিবেশনে আমরা প্রতিফলন অনুশীলন সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
আত্ম-রিপোর্টিং:
আত্ম-রিপোর্টিং আত্ম-বিক্ষণ বা আত্ম-অবলোকনের আরেকটি উপায়। এ পদ্ধতিতে একজন শিক্ষক শিক্ষণ-শিখন কাজে তার আত্ম-উন্নয়নের নির্দেশক সম্বলিত একটি ইনভেনটরি বা চেকলিস্ট ব্যবহার করতে পারেন। অর্থাৎ এ চেকলিস্টে শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক/দিক অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এ কাজে শিক্ষা বিজ্ঞান তথা পেডাগোজির নিরিখে প্রণীত বিভিন্ন প্রতিফলন অনুশীলন চেকলিস্ট যেমন ব্যবহার করা যেতে পারে, তেমনি প্রতিফলনকারী শিক্ষক তার আত্ম-উপলব্ধি থেকে তার উন্নয়নের ক্ষেত্রসমূহ সনাক্ত করে নিজেও চেকলিস্ট প্রণয়ন করে নিতে পারেন। তবে পেডাগোজি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের সহায়তা নিয়ে প্রতিফলন অনুশীলন চেকলিস্ট প্রণয়ন করা শ্রেয়। শিক্ষণ-শিখন বিষয়ের প্রাথমিক নির্দেশক/ক্ষেত্র থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে এ চেকলিস্ট সুক্ষ্ম প্রতিফলন অনুশীলনের জন্য ব্যবহৃত হবে।
পাঠদান রেকর্ডিং:
পাঠদান রেকর্ডিং আত্ম-অবলোকনের আরেকটি কৌশল। এটি প্রতিফলন ডায়েরি এবং রিপোর্টের চেয়ে অধিকতর নির্ভরযোগ্য। কখনো কখনো এটি প্রতিফলন ডায়েরি ও আত্ম-রিপোর্টিং-এর পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম চলাকালে একই সাথে অনেক কিছু ঘটে, যার সবকিছুর নিপুণ আলেখ্য প্রতিফলন ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা যায় না বা সকল ব্যাপার বা ঘটনা স্মরণেও থাকে না। কিন্তু পাঠদান রেকর্ডিং-এর মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষের সমুদয় ব্যাপারের প্রামাণ্য দৃশ্যে দেখতে পাওয়া যায়। এ কৌশল একজন শিক্ষককে সংশোধনের সবচেয়ে ভাল সযোগ করে দেয়। কারণ একজন শিক্ষক তার শিখন-
শেখানো কার্যক্রম পরিচালনার সময় শ্রেণিকক্ষে নিজের অজান্তেই এমন অনেক কিছুই করেন, যা সব, সময় প্রতিফলন ডায়েরি কিংবা রিপোর্টে প্রতিফলিত হয় না। ফলে সংশোধন করার সুযোগও পান না। এক্ষেত্রে রেকর্ডিং বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। রেকর্ডিং প্রসঙ্গে McLaughlin বলেন, Recording cites a striking example of how a teacher discover information about his/her blind and hidden selves through examining a video of his / her class. সর্বোপরি, সেলফ-মনিটরিং বা আত্ম-অবলোকন একজন শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়নের একটি কার্যকর উপায়।
খ. শিক্ষার্থীদের ফলাবর্তন/ফিডব্যাক সংগ্রহ
শিক্ষকের ফলাবর্তন যেমন শিক্ষার্থীরা অহরহ পেয়ে থাকে এবং তাদের জন্য তা অত্যন্ত উপকারী, তেমনি শ্রেণিতে এবং বিদ্যালয়ে শিক্ষকের কার্যক্রম সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মতামত/ফলাবর্তন একজন শিক্ষকের আত্ম- উন্নয়নের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হতে পারে। শিক্ষার্থীরা সর্বদা যেমন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করে তেমনি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া থেকে শিক্ষক নিজেকে পরিবর্তিত রূপে সাজাতে পারেন- যা শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গও বটে।
শিক্ষার্থীর সব ফলাবর্তন বা প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করা সব সময় সব শিক্ষকের জন্য সহজ নয় যদি না শিক্ষক সে ফলাবর্তন/প্রতিক্রিয়াকে তার আত্ম-উন্নয়নের মোক্ষম উপায় হিসেবে গ্রহণ করেন। এ জন্য সবার আগে শিক্ষককে মানসিকভাবে একজন ভাল গ্রহীতা হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের ফলাবর্তন/প্রতিক্রিয়া যতই নেতিবাচক হোক না কেন, শিক্ষক তাতে বিপরীত প্রতিক্রিয়া না করে সে সব ফলাবর্তন/প্রতিক্রিয়াকে নিজের জন্য ইতিবাচক হিসেবে নিবেন।
অযাচিত হলেও তিনি কখনোই শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া প্রাপ্তির পথ বন্ধ না করে বরং একে সুগম রাখবেন। ফলাবর্তন থেকে নিজেকে নিরব না রেখে এটি তার পেশাগত কর্মের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে নিজেকে এর সাথে জড়িয়ে রাখতে প্রস্তুত থাকবেন। শিক্ষার্থী কিংবা সহকর্মীদের ফলাবর্তন/প্রতিক্রিয়া হবে পেশাগত শক্তি/দক্ষতা বাড়ানোর উৎস ফলাবর্তন/ফিডব্যাক সংগ্রহের নানা কৌশল আছে। তন্মধ্যে মতামত জরিপ কৌশল অবলম্বনে একজন শিক্ষক তার নিজের জন্য অর্থবহ ফলাবর্তনের দ্বার উন্মুক্ত রাখতে পারেন।
সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে তার শিক্ষণ আচরণ এবং অন্যান্য পারফরমেন্স সম্পর্কে জরিপ করতে পারেন। জরিপ প্রশ্নমালাকে অবশ্যই বেনামে রাখতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে নির্মোহভাবে কিংবা সততার সাথে মত প্রদান করতে পারে। এরপরে সমীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করতে হবে এবং এ ফলাফলকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। এ বিষয়ে রক্ষণাত্মক না হয়ে শিক্ষার্থীদের প্রদানকৃত ফলাবর্তনকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়ে দুর্বলতা উত্তোরণের পদক্ষেপ নিতে হবে।
গ. অন্য সহকর্মী শিক্ষকদের অনুসরণ/পর্যবেক্ষণ
আত্ম-উন্নয়নের আরেকটি প্রক্রিয়া হলো অন্য সহকর্মী শিক্ষকদের অনুসরণ/পর্যবেক্ষণ। এ অনুসরণ/পর্যবেক্ষণ দুই উপায়ে হতে পারে। একটি উপায় হলো একজন শিক্ষক তার শৈশব থেকে শুরু করে শিক্ষা জীবনের ঐসব প্রসংশিত শিক্ষকদের শিক্ষণ আচরণ ও তাদের অন্যান্য কর্মতৎপরতাকে মানসচক্ষে প্রত্যক্ষণ (Visualize) ও স্মরণ করে সেসব প্রসংশিত শিক্ষণ আচরণকে নিজের জন্য আদর্শ (Model) হিসেবে নিয়ে সেগুলো অনুসরণ ও অনুকরণ করবেন।
এক্ষেত্রে অন্য আরেকটি উপায় হলো সহকর্মী শিক্ষকদের মধ্যে যাদের উচ্চমার্গীয় দক্ষতা ও যোগ্যতা রয়েছে, পেশাগত বিষয়ে তাদের সাথে মত বিনিময়, আলাপ-আলোচনা, তাদের সাথে সময় কাটানো, পুর্বানুমতি সাপেক্ষে তাদের শ্রেণিকক্ষে গমন ও তাদের শ্রেণিকক্ষ কার্যক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা।
পর্যবেক্ষণের আগে ও পরে তাদের সাথে আলাপ-চারিতার মাধ্যমে তাদের পরিকল্পনা, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, প্রস্তুতি গ্রহণ, শ্রেণিকক্ষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার প্রতিফলন প্রক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে জেনে আত্ম-উন্নয়নকামী শিক্ষক বাস্তব জ্ঞান লাভ করতে পারেন। বস্তুত, সহকর্মী কিংবা সতীর্থদের পর্যবেক্ষণ করে তাদের কলাকৌশল, স্টাইল এবং অন্যান্য নৈপুণ্যকে নিজের জন্য উদাহরণ হিসেবে নেওয়া আত্ম-উন্নয়নের একটি মোক্ষম উপায়।
প্রশংসিত সহকর্মী শিক্ষকদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ একজন শিক্ষককে তার নৈপুণ্যের পরবর্তী স্তরে পৌঁছাতে অনুপ্রাণিত করে ।
এবার আসুন, আমরা নিম্নোক্ত বিষয়ে আমাদের অভিমতগুলো লিখি
শিক্ষার্থীদের ফলাবর্তন/ফিডব্যাক সংগ্রহ ও অন্য সহকর্মী শিক্ষকদের পর্যবেক্ষণ করে যেভাবে একজন শিক্ষক নিজেকে উন্নয়ন করতে পারেন-
১.
2.
8.
৫.
ঘ. পেশাগত অধ্যয়ন/পঠন
একজন শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়নে পড়ার গুরুত্ব নতুন করে ব্যাখ্যা করা নিষ্প্রয়োজন। জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে, নিজেকে আবিষ্কার করতে, জ্ঞান প্রসারে, চৌকস হতে, প্রেষণা সৃষ্টিতে, সুক্ষ্ম এবং বিশ্লেষণধর্মী চিন্তন দক্ষতার উন্নয়নে, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে, কল্পনা এবং সৃজনশীলতার প্রসারে, মস্তিস্কের উৎকর্ষ সাধনে, আনন্দ লাভে পড়ার বিকল্প একমাত্র পড়া-ই। ফ্রান্সিস বেকনের সেই উক্তিটি অনেকেরই জানা। পঠন সম্পর্কে তিনি উক্তি করেছেন, ”Reading maketh a full man” তিনি আরো বলেছেন, “কিছু বই গিলতে হয়, কিছু বই চিবিয়ে হজম করতে হয়”।
এখানেও পড়ার কথা বিদ্যমান। পাঠাভ্যাস একজন শিক্ষককে স্মার্ট করে তোলে। পড়াতে হলে শিক্ষককে আগে বেশি পড়তে হবে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, “শিক্ষক হয়েছো ভাল কথা। মনে রাখবে, সারা জীবনের জন্য তুমি ছাত্র হয়ে গেলে”। তাই শিক্ষক হতে হলে আজীবনের জন্য ছাত্র হতে হয়।
শিক্ষক যে বিষয়ে পাঠদান করেন সে বিষয় সংশ্লিষ্ট উচ্চতর রেফারেন্স বই সংগ্রহে রাখা ও পড়া তার জন্য অতীব গুরুত্বপুর্ণ। উল্লেখ্য, সময়ের হাজারো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেফারেন্স বই থাকলে বিশেষ সময়ে বিশেষ প্রয়োজনে তা কম বেশি পড়া হয়ে থাকে। আর যদি তা ব্যক্তিগত সংগ্রহে না থাকে তাহলে ঐ সব বইয়ের সহায়তা ছাড়াই যেনতেন উপায়ে পাঠের প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে থাকে। তথ্য-প্রযুক্তি ও ভার্চুয়াল রিইয়ালিটির এ যুগেও মুদ্রিত রেফারেন্স বই-এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়নি।
সর্বোপরি, দ্রুত পরিবর্তনশীল তথ্য-বিশ্বের সর্বাধুনিক তথ্য শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে এবং নিজেকে চৌকস রাখতে মুদ্রিত পুস্তক কিংবা তথ্য-প্রযুক্তির অন্যান্য মিডিয়ার মাধ্যমেই হোক না কেন, শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়নে নিয়মিত অধ্যয়ন অপরিহার্য। শিক্ষককে মনে রাখতে হবে যে “Teaching is followed by learning”- আর এ লার্নিং বা শিখনের অন্যতম প্রধান একটি চ্যানেল হচ্ছে পড়া। তাই যিনি পড়াবেন, তিনি আগে পড়বেন। পদ্ধতিগত ও কার্যকর শিখন-শেখানো কাজে শিক্ষা বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থসমূহের পঠন একজন শিক্ষকের জন্য অপরিহার্য।
ঙ. সামাজিক মাধ্যম ( Social Media ) -এর ব্যবহার
শিক্ষা ক্ষেত্রের নিত্য নতুন প্রযুক্তি শ্রেণিকক্ষের ভিতরের এবং বাইরের চেহারা প্রতিনিয়ত পাল্টে দিচ্ছে। বর্তমানে শিক্ষকরা যে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ও সংযোগ বিস্তারে সক্ষম হচ্ছেন, অতীতে তা কখনও করতে পারেননি।
চ. নিজের কাছে জবাবদিহিতা ও উৎকর্ষের সাধনা
নিজের কাছে জবাবদিহিতা বা জবাব দিহিতার তাড়না থেকে একজন শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়ন প্রচেষ্টার প্রথম সূত্রপাত হতে পারে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমসহ পেশাগত নানা কাজের মান নিয়ে একজন শিক্ষক যখন আত্ম-জিজ্ঞাসায় নিমগ্ন হন, তখন তিনি নিজের সীমাবদ্ধতাকে আবিষ্কার করতে পারেন এবং তা উত্তরণের পথ খুঁজতে পারেন। এজন্য নিজের কাছে নিজের জবাবদিহিতা হতে পারে আত্ম-উন্নয়ন প্রচেষ্টার প্রথম সোপান। তাই শিক্ষকদের নিজের কাছে জবাবদিহিতা থাকা উচিত। শিখন-শেখানো কার্যক্রম যেমন এক ধরনের বিজ্ঞান, তেমনি এটি কলা তথা শিল্পও বটে।
জানা বিষয়টি কীভাবে আরো নতুন ও আকর্ষণীয় করে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরা যায়, পরিকল্পিত পাঠটি ইতোপূর্বে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বর্তমান উপস্থাপনে তার সাথে নতুন কোন কিছু সংযোজন করা যায় কিনা— এসব নিয়ে নিরবছিন্ন চিন্তা-ভাবনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সমীক্ষা, অভীক্ষা থেকে একদিকে যেমন তিনি শিক্ষার্থীদের শিখন বিষয়টি (Learning Object) অপেক্ষাকৃত সহজে ও কার্যকরভাবে শিখাতে পারবেন, তেমনি অন্যদিকে এর মাধ্যমে শিক্ষক নিজেকে রীতিমত একজন উদ্ভাবনী, সৃজনশীল ও গবেষক শিক্ষকে রূপান্তর করতে পারেন- যা তার চর্চা তথা শিক্ষণ কার্যক্রমকে ক্রমান্বয়ে উন্নত করে।
সর্বোপরি, শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে যুগোপযোগী ও কেতাদুরস্ত রাখতে একজন শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়ন অব্যাহত রাখা অত্যাবশ্যক। শিক্ষকের কর্মপরিধির মূলকেন্দ্র হচ্ছে শ্রেণিকক্ষ। সময় ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ শ্রেণিকক্ষের শিখন-শেখানো কার্যক্রমের ধারা ও পদ্ধতি ও পরিবর্তনশীল। এ পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে প্রচলিত আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপই যথেষ্ঠ নয়।
শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়নে কর্মকালীন প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম বা অন্যান্য আনুষ্ঠানিক উদ্যোগের প্রায় সবগুলো সাধারণত বাহির থেকে আরোপিত উদ্যোগ। এসব আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপের বাইরে শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়নে বিশেষত শিখন-শেখানোর দক্ষতার উন্নয়নে আত্ম-প্রচেষ্টামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। শিক্ষকের আত্ম-উন্নয়নে এসব পদক্ষেপ সবচেয়ে বেশি কার্যকর। কারণ এ ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে কেবল ভেতরকার তাগিদ থেকেই একজন শিক্ষক স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিভিন্ন ধরনের স্বশিখন পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করে আত্ম-উন্নয়নে ব্রতী হন।
আরও দেখুনঃ