অপঘাত ছোটগল্প

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় অপঘাত ছোটগল্প

অপঘাত ছোটগল্প

 

অপঘাত ছোটগল্প

 

অপঘাত ছোটগল্প

লেখক-পরিচিতি

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রংপুর ও বর্তমান গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার গোটিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে বিশিষ্ট কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস এবং মা মরিয়ম ইলিয়াসের চার পুত্রের মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। ইলিয়াসের জন্মকাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের (১৩৫০ বঙ্গাব্দ) মহামন্বন্তরের সময়চিহ্নিত।

এ সময়ে বগুড়া জেলা মুসলিম লীগের সেক্রেটারী জেনারেল ইলিয়াসের পিতা বগুড়া জেলার অন্তর্গত সারিয়াকান্দি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে কর্মরত ছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের শৈশবের কয়েক বছর অতিবাহিত হয় পিত্রালয় বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষা নারুলি গ্রামে। পিতার দলীয়-রাজনীতি-সংশিষ্ট জীবনের কারণেই ইলিয়াসকে অল্প বয়সেই গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসতে হয়।

তার পিতা ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় সপরিবারে ঢাকায় স্থানান্তরিত হন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস লক্ষ্মীবাজারে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরের বছর দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে কেএল জুবিলি স্কুলে স্থানান্তরিত হন তিনি। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে সরাসরি চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন ইলিয়াস।

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে আবার স্কুল পরিবর্তন করে বগুড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন তিনি। ঐ স্কুল থেকেই ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ইলিয়াস। বগুড়া জেলা স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন সময়েই সাহিত্যজগতে প্রবেশ ঘটে তাঁর। সত্যযুগ ও আজাদ পত্রিকার ছোটদের পাতায় তাঁর লেখা এ সময়ে প্রকাশিত হয়। তিনি যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র, তখন ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ছোটগল্প।

ম্যাট্রিক পাস করার পর ইলিয়াস পুনরায় ঢাকায় ফিরে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং ঐ কলেজ থেকে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে আই.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ইলিয়াস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং এখান থেকে ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে যথাক্রমে বি.এ অনার্স ও এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কর্মজীবন শুরু হয় করটিয়ার সাদত কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দিয়ে।

তবে এখানে যোগদানের কয়েকদিন পরই ইলিয়াস ঢাকার জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। তাঁর অখন্ড শিক্ষকতা জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে ঐ কলেজে। তবে সরকারি কলেজে চাকরির সূত্রে অন্যান্য কলেজেও তাঁকে স্থানান্তরিত হতে হয়েছে সময়ে সময়ে। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রফেসর পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্ত্রীর নাম সুরাইয়া ইলিয়াস ।

বাংলা কথাসাহিত্যের অবিস্মরণীয় লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন তাঁর গল্পের উপন্যাসে। দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও, রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বিশেষত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসমূহের প্রতি ছিলো তাঁর অপার আগ্রহ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পূর্ববর্তী আন্দোলনসমূহ তাঁর রচনায় বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। পুরনো ঢাকা, তাঁর জনজীবন ও ভাষা ইলিয়াসের গল্পের অন্যতম প্রধান উপকরণ।

তাঁর রচনাভান্ডার বিশাল না হলেও বিষয় ও প্রকরণ উভয়দিক থেকেই অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সাহিত্যকৃতীর স্বীকৃতি স্বরূপ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লাভ করেন বাংলাদেশ লেখক শিবির প্রদত্ত হুমায়ুন কবির স্মৃতিপুরস্কার (১৯৭৭), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), প্রফুল কুমার সরকার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৬), সাদত আলী আকন্দ পুরস্কার (১৯৯৬) এবং কাজী মাহবুবউলাহ স্বর্ণপদক (১৯৯৬)।

১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি ঢাকার কমিউনিটি হাসপাতালে মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জীবনাবসান ঘটে।

পাঠ- পরিচিতি

‘অপঘাত’ গল্পটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-এর দোজখের ওম গল্পগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত চারটি গল্পের তৃতীয়গল্প ‘অপঘাত। দোজখের ওম ঢাকার প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা থেকে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম প্রকাশিত হয় ।

ব্যক্তিক ও পারিবারিক স্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ‘অপঘাত’ গল্পের বিষয়বস্তু। তবে ব্যক্তিক ও পারিবারিক সংকট অতিক্রম করে গল্পটি মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশকে মূর্ত করে তুলেছে। সর্বজ্ঞ লেখকের উপস্থাপনা কৌশলে গল্পটি বর্ণিত হলেও, প্রায় সমগ্র গল্প জুড়েই বিন্যস্ত হয়েছে কেন্দ্রীয় চরিত্র মোবারক আলির দৃষ্টিকোণ, তার উপলব্ধি প্রতিক্রিয়া ও মূল্যায়ন।

গত্মকারের বর্ণনার পরতে পরতে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বগুড়া জেলার একটি ইউনিয়ন কাউন্সিলের কেরানি মোবারক আলির অন্তর্ময় ভাবনাপুঞ্জকে অসামান্য দক্ষতায় বিন্যস্ত করে দিয়েছেন গত্মকার। মোবারক আলির ভাবনার অনুষঙ্গ ধরেই গল্পের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটেছে অন্যান্য চরিত্রের। মুক্তিযুদ্ধ ও গ্রামীণ বাস্তবতানিষ্ঠ উপমা ও চিত্রকল্প যোজনার পাশাপাশি গল্পকার একইসঙ্গে অপভাষা ও বগুড়ার আঞ্চলিক উপভাষা ব্যবহারেরও দিয়েছেন সাফল্যের পরিচয়।

মোবারক আলির কলেজ পড়ুয়া ছেলে সুলতান ওরফে বুলু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নেই যোগ দেয় মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিবাহিনীর একজন সক্রিয় সংগঠক ও সদস্য হিসেবে গেরিলা যুদ্ধে জীবনাবসান ঘটে তার। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে বৌ-ডোবা খালের ব্রিজে মাইন পোঁতার মিশনে সহযোদ্ধাদের নিয়ে অংশ নেয় বুলু। মাইন পোঁতার প্রাক-মুহূর্তে এগিয়ে আসা মিলিটারি জীপের আওয়াজ পেয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বুলু গ্রেনেড নিক্ষেপ করে জীপে।

এতে পাক সেনাদের অনেকেই নিহত হয়। কিন্তু গ্রেনেড নিক্ষেপের পূর্বে জীপ থেকে লাফিয়ে পড়া একজন পাক সেনার নিক্ষিপ্ত দুটি গুলিতে বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায় বুলুর। শহীদ পিতা মোবারক আলি জানে তার পুত্রের এই আত্মদান আকস্মিক দুর্ঘটনার পরিণতি নয়, নয় অপমৃত্যুও। তবু পরিবারের ও গ্রামবাসীর নিরাপত্তার স্বার্থেই পুত্র বুলুর বীরত্বকাহিনী সাধারণ্যে গোপন রাখে সে। ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে বসেছে পাকমিলিটারিদের ক্যাম্প।

মিলিটারি ক্যাপ্টেন-এর আকস্মিক জিজ্ঞাসার সম্ভাব্য উত্তর তাই মনে মনে সাজিয়ে রাখে মোবারক আলি। জিজ্ঞাসার উত্তরে সে বলবে তার ছেলে বুলুর মৃত্যু হয়েছে অপঘাতে। বুলুর মায়ের একটানা কান্নার শব্দে আতঙ্ক-শিহরিত মোবারক আলি সব ঘটনা স্ত্রীর কাছে সবিস্তরে বর্ণনা করেও অপঘাতে মৃত্যুর বিষয়টি শহীদ জননীর ধারণাতেও প্রোথিত করে দেয়। তবে গল্পের শেষে মোবারক আলী গোপন রাখতে পারে না তার অন্তর্গত বিক্ষোভ ও গৌরব।

পূর্বেই চেয়ারম্যানকে সে অবহিত করেছে ঘটনা, এবারে মসজিদের ইমাম-কাম-মোয়াজ্জিনের কাছেও সবিস্তারে বর্ণনা করে শহীদ পুত্রের আত্মদানের কাহিনী। চেয়ারম্যানের একমাত্র পুত্র বুলুর বিদ্যালয়— জীবনের সহপাঠী শাজাহানের টাইফয়েড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ও তার প্রতিক্রিয়া ক্ৰমে আত্মস্থ হতে সাহায্য করে মোবারক আলীকে। শাজাহান মৃত্যুর পূর্বে বিকারাবস্থায় সহপাঠী মুক্তিযোদ্ধা বুলুর নাম ধরে ডেকেছে বার বার, প্রকাশ করেছে বুলুর সঙ্গে চলে যাবার ব্যাকুলতা।

এই তথ্য শোনামাত্র বুলুর আত্মবলিদান নবমাত্রা পেয়েছে পিতা মোবারকের কাছে। ফলে অনেক টানাপোড়েনর শেষে দ্বিধান্বিত মোবারক উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, রোগভোগে সাধারণ মৃত্যুর সঙ্গে, দেশের জন্য পুত্রের আত্মবলিদানের তুলনা হয় না। শহীদ পিতার এই আত্মোপলব্ধিই ‘অপঘাত’ গল্পের ভাবৈশ্বর্যের শীর্ষচূড়ান্ত। গল্পের শেষে ভয়মুক্ত নির্ভয় মোবারক স্ত্রীর একটানা কান্নায় পূর্বেকার মতো শঙ্কাতাড়িত হয় না।

বরঞ্চ সন্ধ্যার পরেও বাড়ি ফিরতে দেরী হওয়ার কারণে তার জন্য স্ত্রীর ব্যাকুলতা মোবারকের কাছে অস্বাভাবিক প্রতীয়মান হয় বলেই সে এমন ভাবনা ভাবতে পারে যে, ‘যার ছেলে মারা গেছে মাস দুয়েকও হয়নি, সেই মা অন্য কারণে উতলা হয় কিভাবে? সন্ধ্যার পর ছেলের জন্য হামলে কেঁদে মা যদি সারা গ্রাম মাথায় না তুললো তো বুলু এরকম মরা মরতে গেছে কোন দুঃখে?”

আয়রনির ব্যবহার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘অপঘাত’ গল্পের নামকরণে সঞ্চারিত আয়রানির বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা গল্পটিকে গল্পটির ব্যতিক্রমী রসাবেদনের মূল ভিত্তি। আকস্মিক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বা অপমৃত্যুর সমার্থক শব্দ অপঘাত দেশের জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক প্রয়োগ নয়। গল্পকারও বিষয়টি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন।

প্রথম পর্যায়ে বুলুর ভীতসন্ত্রস্ত পিতা পুত্রের অপঘাত মৃত্যুর কথা বলে আসন্ন বিপদ থেকে মুক্তির পথসন্ধান করেছে। জোয়ান বাঙ্গালী ছেলের অপঘাত মৃত্যুর সঙ্গে পাক-মিলিটারির কাছেও গ্রহণযোগ্য সংবাদ হিসাবে গণ্য হবে— এ বিশ্বাসও সক্রিয় ছিল মোবারকের ভাবনায়। কিন্তু গল্পের শেষে, যুদ্ধের ময়দানে বুক উচিয়ে বুলুর আত্মবলিদান মোবারকের ভাবনায় মহৎ গৌরবরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

তবু গল্পকার পাক-মিলিটারির দৃষ্টিকোণকে তীব্র বিদ্রূপে বিদ্ধ করে গল্পের নামকরণ করেছেন ‘অপঘাত’। একটি ব্যতিক্রমী ও শিল্পকৌশল হিসেবে এ নামকরণ তাৎপর্যবহ।

মূলপাঠ

ডুকরে ওঠা কান্নার একেকটি ধাক্কায় মোবারক আলীর বন্ধ চোখের মণি কাঁপে, চোখের পাতা আলগা হয়ে আসে, তার বাঁ পায়ের পাতা শিরশির করে। দুই হাঁটুর ভেতর হাতজোড়া ভাঁজ করে ডান কাত করে শুলে বাঁ পায়ের পাতার ওপর একজিমা চুলকাবার জন্য উঠে বসার উৎসাহ পায় না। এদিকে দেখতে দেখতে কান্নার ফাঁকগুলো সব ভরে যায় এবং কান্না একটানা বিলাপে পরিণত হয়ে তার ঝুনা করোটির ভেতরকার ঠকঠক দেওয়ালে ঘনতালে বাজতে থাকে।

বাজনাটা একবার বৃষ্টির বলে মনে হয়েছিল; কিন্তু বৃষ্টিপাতের ফলে ঘরের কান্নাটির খবর বাইরে যাবে না- এই আশা করে একটু নিশ্চিত হবার আগেই বৃষ্টির বিভ্রম কাটে। বিলাপের আওয়াজ তার আঁশের মতো চুলের গোড়ায় গোড়ায় হ্যাঁচকা টান মারে। টানাটানির ফলে চোখের ঢাকনি সম্পূর্ণ উদাম হলে মোবারক কিছুই দেখতে পায় না, ঘরে ঘোনঘোট অন্ধকার। ভালো করে তাকাবার বলও তার নাই, ঘুমভাঙা শরীরে স্ত্রীর বিলাপ অবিরাম ঠেলা দেওয়ায় সে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।

তবে কি-না মুণ্ডুর প্রতিক্রিয়ায় নিস্তেজ শরীরেও মোবারক আলি বিরক্ত হাওয়ার বলটুকু পায়: এটা কি বিলাপ করার টাইম হলো ? এই বয়সেও বুলুর মায়ের কাণ্ডজ্ঞান হলো না তো হবে কবে? ২৫০/৩০০ গজ দূরে হাইস্কুলের দালানে মিলিটারির ক্যাম্প, স্কুলের বারান্দায় গাদা গাদা বালুর বস্তার আড়ালে থাবার মতো সব হাতে ধরা রয়েছে কতো কিসিমের অস্ত্র, মোবারক ওসবের নামও জানে না, শুনলেও তার মনে থাকে না।

সপ্তাহ খানেক হলো ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসটাও মিলিটারি দখল করে নিয়েছে, সে তো ১৫০ গজও দূরে হবে না। বুলুর মায়ের বুকের পাঁটা কতো বড়ো যে এইভাবে বিলাপ করে কাঁদে? মেয়েমানুষের এতো সাহস ভালো না, সব ছারখার করে ফেলবে। এই বিলাপ শুনে ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিস থেকে দুজন সেপাই এসে পড়লে মোবারক আলির ক্ষমতা হবে যে তাদের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ায়? তারপর সেপাই, মানে সেপাই সাহেব যদি জিগ্যেস করে তোমার বৌ কাঁদে কেন?

– তো সে কি জবাব দেবে? যদি বলে তোমার ছেলেমেয়ে কটা? ? – তখন না হয় বলা যাবে, জি দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে জানাতে হবে মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়ে গেছে, তারা সব স্বামীদের সঙ্গে থাকে। তবে ছোট মেয়েটা দুমাস হলো এখানে এসেছে, তিনদিন আগে সে গেছে তার মামাবাড়ি।

তার মামা আলেম মানুষ, ঠনঠনিয়া মোস্তাফাবিয়া মাদ্রাসার হেড— মোদাররেস, সারা শীতকালটা ওয়াজ করে বেড়ায়, জেলা জুড়ে তার নাম। সেপাই ধমক দিতে পারে, আরে, এতে তার বিবির কান্নাকাটির কি হলো? ঠিকভাবে কথার জবাব দাও। তখন বাধ্য হয়ে বলতে হবে যে তার বড়োছেলের মৃত্যুই হলো তার স্ত্রীর কান্নাকাটির কারণ। বড়ো ছেলে? জি, আমার দুই ছেলে, ছোটটা ঘরেই আছে, ক্লাস ফোরে পড়ে।

সেপাই চটে যাবে, বাখোয়াজি রাখো। বড়োটা মারা গেছে? কি করত? – জি কলেজে পড়ত। কলেজে পড়তো? মুক্তি ছিলো? কিভাবে মরলো? হুজুর, অপঘাতে মারা গেছে। অপঘাত? অপঘাত কেয়া হ্যায়? না, মানে এ্যাক্সিডেন্ট হ্যায় না? হেঁ হেঁ। ক্যায়সা এ্যাক্সিডেন্ট? সাচ বলো! এরপর মোবারক আলি আর বলতে পারবে না । – জি না স্যার, জি না হুজুর, জি না মেজর সাহেব, জি না ক্যাপ্টেন বাহাদুর, আমি কিছু জানি না।

— শালা তোমার ছেলে মিসক্রিয়ান্ট ছিলো? তোমার ঘরে তুমি মিসক্রিয়ান্টের শেলটার দাও?- না হুজুর! – – মিসক্রিয়ান্টের কথা সে জানে না। ইউনিয়ন কাউন্সিলের কেরানি মোবারক আলি হাজার হলেও পাকিস্তান গভর্মেন্টের চাকরি করে, জি, তার বেতন আসে বগুড়া ট্রেজারি থেকে মিসক্রিয়ান্টদের খবর সে রাখবে কোত্থেকে? – – না, তার শুকনা এবং কাঠ কাঠ গলা থেকে এইসব বাণী হাঁকা অতো সহজ নয়।

মিলিটারির সঙ্গে কাল্পনিক বাক্যবিনিময়ের সংকল্পে তার বল তাই বাড়ে না। তার পাশে শুয়ে থাকা ছোট ছেলে টুলু ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কি বলে, তাতে মোবারক আলির তন্দ্রা একেবারে ছিড়ে যায় এবং সে উঠে বসে। এখন আর শিরশির না করলেও একজিমার খানিকটা চুলকে নেয় এবং পাশের ঘরে দেড় বছরে নাতিটা হঠাৎ কেঁদে ওঠে। তখন তার মগজের ময়লা কাটে। মোবারক আলি বোঝে যে এই একটানা বিলাপের উৎস তার নিজের বাড়ি নয়।

আওয়াজ আসছে দক্ষিণ থেকে। নাতি তার ফের কাঁদে এবং মোবারকের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় : চেয়ারম্যানের ছেলেটা তা হলে মারা গেলো। – বিকালেও সে চেয়ারম্যানের বাড়ি গিয়েছিলো। ইউনিয়ন কাউন্সিলে মিলিটারি ক্যাম্প হবার পর থেকে অফিসের টুকটাক কাজ সারতে হয় চেয়ারম্যানের বাড়িতে। বিকালবেলা চেয়ারম্যানের চোখমুখ একটু হালকা মনে হচ্ছিলো, শাজাহান মনে হয় একটু ভালো।

না,ভালো আর কোথায়? জ্বরটা রেমিশন হচ্ছেনা, তবে একটু আগে লেবু দিয়ে প্রায় এক গাস বার্লি খেয়েছে। চেয়ারম্যান একটু আলাপও করলো, এখানে চিকিৎসা একেবারেই হচ্ছে না, অবস্থা একটু ভালো হলে বগুড়া পাঠাবে। চার গাঁয়ের এক ডাক্তার চেয়ারম্যানেরই কিরকম এক চাচাতো ভাই, একই বাড়ি, মার্চের প্রথম দিকে দিনাজপুরে শ্বশুর বাড়ি গেলো মরণাপন্ন সম্বন্ধীকে দেখতে, গোলমাল শুরু হতেই ওপারে ভাগল ওরা।

আর সেরপুরের বীরু সান্যাল, পুরনো আমলের ন্যাশনাল পাশ – ১০/১২ বছর আগেও এই গ্রামের সবাই তার কাছেই যেতো, তা শোনা যাচ্ছে বর্ডার পার হবার সময় বেয়নেটের খোঁচায় বুড়ো সাফ হয়ে গেছে। ছেলেকে নিয়ে চেয়ারম্যান এখন যায় কোথায়? গোরুর গাড়ি করে সেরপুর পর্যন্ত না হয় গেলো, সেরপুরে জনমনিষ্যি কেউ নাই, বড়ো রাস্তায় খালি মিলিটারি খালি মিলিটারি।

তা এখানে হাইস্কুল ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে চেয়ারম্যানের একটু আলাপ হয়েছে, তবে ওদের সাহায্য চাইতে ভয় হয়, ঘরে সোমত্ত বয়সের মেয়ে আছে, কিসের বিনিময়ে আবার কি চেয়ে বসে। তা দ্যাখা যাক, আজ তো বার্লি খেলো, অবস্থা একটু ভালো হোক, এর মধ্যে কি অনেকটা নর্মাল হবে না? দেশের অবস্থা নর্মাল হওয়ার আগেই ছেলেটা মারা গেল? তাহলে সন্ধার পর থেকে কি খারাপ হচ্ছিলো?

মনসুর সরকার কয়েক বছর থেকে হোমিওপ্যাথিক প্রাকটিস করে, কাউকে না পেয়ে তাকে দ্যাখানো হলো, তার ডায়াগনোসিস হলো টাইফয়েড। দুর টাইফয়েড কি দুটো সপ্তাহ সময় দেবে না? ১০/১২ দিনেই সব শেষ হয়ে গেলো? আহা! ছেলেটার মায়ের স্বর স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তার সঙ্গে ছলকে ওঠে চেয়ারম্যানের মায়ের কান্না। এদের কান্নাকে মোবারক বুলুর মায়ের বিলাপ বলে ভুল করল কি করে?

স্ত্রীর জন্য তার মায়া হয়, শোকে বুলুর মা একেবারে কাঠ হয়ে গেলো! বৌয়ের ওপর সে মিছেমিছি রাগ করছিলো। বিছানা থেকে নেমে মোবারক আলি ঘরের উল্টো প্রান্তে বৌয়ের বিছানার দিকে পা বাড়ালো। তক্তপোষের কাছাকাছি যেতে পা লেগে নেভানো হারিকেনটা গড়িয়ে পড়ে। কেরোসিনের ঝাঁঝালো গন্ধে মাথা আরেকটু পরিষ্কার হয়। মনে পড়ে যে নাতিকে নিয়ে বুলুর মা শুয়ে রয়েছে পাশের কামরায়। এই ঘরটায় থাকতো বুলু।

মোবারক আলি একটু দমে যায়, তবু অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে বারান্দা দিয়ে সে পাশের কামরায় ঢোকে। বুলুর মা বলে ওঠে, ‘আস্তে হাটো, টেবিলের উপর দুধের বোতল, কাঁচের গিলাস।’ মোবারককে এইসব বলার দরকার হয় না। রাত্রিবেলা এ ঘরের ভূগোল মোবারকের মুখস্থ। আজ ২ রাত হলো বুলুর মা এখানে শোয়, কিন্তু বুলুর খবর শোনার পর থেকে মোবারক অনেক রাত্রে পেচ্ছাব করেত বেরিয়ে একবার করে এই ঘরে বসে। অল্পক্ষণ বসে, কাঠের চেয়ারে পাছা ঠেকাতে না ঠেকাতেই উঠে নিজের ঘরে যায়।

কিন্তু তার জানা আছে কোথায় বুলুর তক্তপোষ, কোথায় তার কেরোসিন কাঠের টেবিল। টেবিলে পুরনো কেলেন্ডারের মলাট লাগানো বই, খাতা, দোয়াত, কলম কিভাবে সাজানো সব তার জানা। বিছানার দিকে এগোবার বদলে মোবারক টেবিলের বইপত্র হাতড়াতে শুরু করে। বুলুর মায়ের সাড়া পেয়ে সে বিড়বিড় করে, ‘দিয়াশলাই পাই না,দুর!’ ‘বাতি জ্বালায়ো না।’ স্ত্রীর ভিজে ভিজে গলায় এই সতর্ক নিষেধ শুনে মোবারক এসে দাঁড়ায় তক্তপোষের মাথায়।

মাস দেড়েক হলো প্রতিরাতে পেচ্ছাব সেরে এ ঘরে এসে ঠিক এখানেই দাঁড়িয়ে মোবারক বিছানাটা ভালো করে ঠাহর করার চেষ্টা করে। আজ তার মাথায় তন্দ্রার রেশ নাই, সুতরাং বুলুর ঢ্যাঙা শরীরটাকে এখানে শুইয়ে অন্ধকারে নয়ন ভরে আর দ্যাখা হয়ে ওঠে না। চোখজোড়া তাই ফাঁকা ফাঁকা ঠেকে এবং বিছানার ওপরকার শূন্যতা চোখের মধ্যে নুন হয়ে জমতে শুরু করলে নিজেকে সামলাবার জন্য তাকে অনাবশ্যক স্বাভাবিক গলায় বলতে হয়, চেয়ারম্যানের ব্যাটা বুঝি মারা গেলো!

— শাজাহানের মৃত্যু সংবাদ সম্পূর্ণ প্রকাশিত হওয়ার আগেই বুলুর মা ফোঁপাতে শুরু করে। এই ফোঁপানো হলো কোন দীর্ঘকান্নার রেশ। বুলুর মা তাহলে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছে। ঘুম ও তন্দ্রার ভেতর দক্ষিণ পাড়ার আখন্দবাড়ির বিলাপকে যখন সে স্ত্রীর কান্না বলে ভুল করে, বুলুর মা তখন কাঁদছিলোই। তবে বাইরের বিলাপের তোড়ে রোগা গলার কান্না চাপা পড়েছিলো। স্ত্রী বিলাপ করেছিলো বলে একটু আগে তার ওপরে রাগ করায় মোবারকের যে অস্বস্তির মতো হচ্ছিলো তা এখন কেটে যায়।

 

অপঘাত ছোটগল্প

 

স্ত্রীর ওপর বিরক্ত হবার সুযোগটি সে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করে, ‘আস্তে! আস্তে কান্দো ! বিপদ বোঝো না? চুপ করার চেষ্টায় বুলুর মায়ের কান্না আরো উথলে ওঠে। কান্নায় সম্পূর্ণ মগ্ন থাকায় এবং অন্ধকারের জন্যেও বটে, বুলুর মা স্বামীকে দেখতে পাচ্ছে না। ভয় ও রাগে মোবারক আলির চোখমুখানাকঠোঁটের ওলটপালট হবার দশা: বুলুর মা সারাটা জীবন কি অবুঝ মেয়েমানুষই থেকে যাবে?

তার কান্না শুনে মিলিটারির ১ জন সেপাই যদি এসেই পড়ে তখন এই পুত্র শোকের ব্যাখ্যা করা যাবে কি করে? তখন কি খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে না? তারপর? তারপরে? তারপরের ঘটনা মোবারকের জানা আছে। তাকে ধরে নিয়ে যাবে স্কুলের দালানে, হেডমাষ্টারের কামরায় এখন টর্চারের সেল। মোবারক আলির মেরুদন্ড শিরশির করে। সুতরাং টর্চার সেলের ছবি তাড়াতাড়ি মুছে ফেলার জন্য সে কাতর হয়। তার বাড়িতে ওরা নির্ঘাত আগুন ধরিয়ে দেবে।

এই পুরনো মাটির বাড়ি, টিনের চাল, বাশের সিলিং— সব দাউদাউ করে জ্বলবে। আগুনের আঁচ সে এখনি অনুভব করতে পারে। তলপেটে আগুনের আঁচ লাগে। তার ভয় হয় যে লুঙিতে প্রস্রাবের ফোঁটা পড়ছে। একটু বাইরে গেলে হতো। কিন্তু এও তার জানা আছে যে বাড়ির পেছনে ভেরেণ্ডা ঝোপে বসলে গুণে গুণে ৮ ফোঁটা পড়বে কি-না সন্দেহ। সে প্রায় চিৎকার করে ধমক দেয়, ‘চুপ করো, বুলুর মা চুপ করো। সোয়াগ দ্যাখাবার টাইম পাও না, না?’ ধমকে কাজ হয়। বুলুর মা চুপ করে।

এই সুযোগে মাথা তোলে দক্ষিণপাড়ার বিলাপ । মোবারক আলি হঠাৎ খুব জোরে নিশ্বাস ফেলে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া পাছাটিকে ধপাস করে তক্তপাষের একধারে ফেলে দিলে বুলুর মা বলে ‘আস্তে’! এই একটি মাত্র শব্দে স্বামীর প্রতি তার অনাস্থা বা সাময়িক অনাস্থা প্রকাশ পায়। প্রায় মিনিটি দুয়েক পার হলে মোবারক আলির শিরদাঁড়ায় স্পন্দন থিতিয়ে আসে এবং আপোশ আপোশ গলা করে সে বলে, ‘চেয়ারম্যানের একটাই ব্যাটা গো।’

শাজাহানের জন্যে মোবারক আলির খারাপ লাগে। এই শাজাহান স্কুলে সাত বছর বুলুর ক্লাসমেট ছিলো, আহারে! না, স্কুলজীবনে দুজনে তেমন খাতির হয়নি। শাজাহান ছাত্র খুব ভালো, রাতদিন লেখাপড়া নিয়ে থাকে। বুলু গড়পড়তা ছাত্র, সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেই খুশি। ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েও শাজাহানের তৃপ্তি হয়নি, আর ক’টা নম্বর পেলেই সে অনেক ভালো করতো।

এই নিয়ে তার আক্ষেপের আর শেষ নাই। শাজাহান বছরের ১টা মাস কোনো না কোনো রোগে ভোগে, নইলে চেয়ারম্যান কি তাকে গ্রামের স্কুলে ফেলে রাখে? শহরে তাদের কতো আত্মীয়স্বজন, জেলা স্কুলে পড়লে কেবল রোল নম্বর নয়, খবরের কাগজে তার নামও ছাপা হতো। এস এস সি’র পর শাজাহান শুনলো না, জেদ করে ভর্তি হলো ঢাকায়। বুলু গেল বগুড়া কলেজে। অথচ, তখন থেকে দুজনের ভারি ভাব, ছুটিতে বাড়ি এলে প্রায় সারাদিন এক সঙ্গে কাটায়।

শাজাহান ছেলেটি ভারি ভদ্র, বাপ চাচাদের মতো কথায় কথায় খোঁচা মারা কথা বলে না। – ভোলার জন্য মোবারক আলি শাজাহানের কণ্ঠস্বর মনে করার চেষ্টা করে, আহা কি অমায়িক ছেলে, দ্যাখা হলেই বুলুর কথা পামালেকুম চাচা, বুলু বাড়ি নাই?- আহা, সেই ছেলে কয়েকদিনের জ্বরে এভাবে— । — শাজাহানের জন্যে শোকটা তারিয়ে তারিয়ে দেখবে, তা বুলুর মা তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে আস্তে আস্তে ফোঁপাতে লাগলো। ছেলের শোক বহন করার চেষ্টা সে এখন করছে একা একা !

মেয়েমানুষের দৌড় মোবারক আলির জানা আছে। একটু পরেই তার হাত জড়িয়ে হাউমাউ করতে শুরু করবে। কেন, ছেলেকে আগলে রাখতে পারোনি, এখন হায় হায় করে লাভ কি? বুলুটা বড্ডো বেশি বেড়ে গিয়েছিলো। মুক্তিবাহিনী করে তোরা করলিটা কি? মিলিটারি এসে গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে দিচ্ছে, মরা ছাড়া তোরা আর কি বালটা ছিঁড়তে পারিস? রাগে মোবারক আলি মনে মনে মুখ খারাপ করে। করবে না?

মিলিটারি কলেরার মতো আসে, ম্যালেরিয়ার মতো আসে। যে গ্রামে একবার হাত দেয় তার আর কোনো চিহ্ন রাখে না। গতকাল বৃহস্পতিবার গেলো, তার আগের বৃহস্পতিবার মাইল ছয়েক উত্তরে মালিয়ানডাঙায় মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা এক রাত্রির জন্য আশ্রয় নিয়েছিলো। একদিন পরে, শনিবার দিনগত রাত্রে সিঙড়া ক্যাম্প থেকে মিলিটারি এসে গোটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিলো। প্রাইমারি স্কুলটাও বাদ দেয়নি, – তা মুক্তিবাহিনী, তোরা কি করতে পারলি?

সরকার বাড়ির ল্যাংড়া জমির আলির মেয়ে আর ভাইঝিকে নিয়ে গেলো। কি ব্যাপার? না, তাদের নামে কমপেন আছে। মেয়েমানুষের নামে কমপেন? – হ্যাঁ, তারা সব ইনফর্মার, মুক্তিবাহিনীকে খোঁজখবর পাঠায়। তাদের একজন ফিরে এলো দিন দশেক পরে। সেই মেয়েকে নিয়ে ল্যাংড়া জমির আলি যে মুসিবতে পড়েছে, কপালে তার আরো কতো কি যে ভোগান্তি আছে! — গজব! গজব! গজব ছাড়া এসব কি?

চেয়ারম্যান যে চেয়ারম্যান – যে সরকারই আসুক. লোকটা ঠিকঠাক সামলাতে পারে, সবাইকে খুশি করার মতো ক্ষমতা তার আলার রহমতে ভালোই আছে, তো সেই চেয়ারম্যান পর্যন্ত পরশুদিন সকাল বেলা মোবারক আলিকে বলে, ‘মোবারক মিয়া, ডাঙর বেটিছেলেকে বাড়িতে না রাখাই ভালো গো!’— ‘কেন?’— মোবারকের অজ্ঞতায় চেয়ারম্যান বিরক্ত হয়, ‘বোঝেন না? ইউনিয়ন কাউন্সিলের মধ্যে মিলিটারি ক্যাম্প করিছে, একরকম ঘরের মধ্যেই ঢুকলো, না কি কন?

মিলিটারি সব মানুষ তো একরকম নয়। হাতের পাঁচ আঙুল কি এক সমান হয়? আবার এটাও কই, দুই চারিটা মাথা খারাপ মানুষ না থাকলে মিলিটারি চলে না।’ চেয়ারম্যানের পরামর্শে মোবারক আলি তার ছোটো মেয়েকে পাঠিয়ে দিলো সম্বন্ধীর সঙ্গে। চেয়ারম্যানও তার মেজো মেয়েটিকে সঙ্গে দিলো। মেয়েটি বেশ ফর্সা, নাকমুখ চোখে পড়ার মতো, তাই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

মোবারক – আলির সম্বন্ধী নামকরা মওলানা, জেলার নামকরা মাদ্রাসার হেড মোদাররেস, গোলমালের জন্য মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় বাড়িতেই থাকে, আলা— আলা করে, মানুষকে হেদায়েত করে, – সেটাই চেয়ারম্যানের ভরসা। কুদ্দুস মওলানা লোকও খুব ভালো। কোত্থেকে ভাগ্নের খবর পেয়ে বোন-ভগ্নীপতির সঙ্গে দ্যাখা করতে এসেছিলো।

আহা, উপযুক্ত ভাগ্নে তার, তারওপর কি-না খোদার গজব পড়লো, নইলে এভাবে গুলি খেয়ে মরে? মোবারক আলি ফিস ফিস করে জানায় যে এখানে এসব নিয়ে কথাবার্তা না বলাই ভালো। মিলিটারি খবর পেলে নির্বংশ করে ছাড়বে। তা মওলানা সাহেব জবান দিয়ে গেছে, বাড়ি গিয়ে বুলুর নামে কোরান খতম করাবে, আরো যা যা করার সব করবে। তারপর মোবারক আলির এক কথায় ভাগ্নীকেও সঙ্গে নিলো, এমনকি জোহরার দেড় বছরের ছেলেটিকেও নিতে চেয়েছিলো।

কিন্তু মেয়ের শরীরের কথা ভেবে বুলুর মা নাতিকে রেখে দিলো। পোয়াতি মেয়ে, – জমির আল দিয়ে, বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে লুকিয়ে ছাপিয়ে যাবে, কোলে বাচ্চা থাকলে বিপদে আপদে সামলাতে পারবে? জামাই ঢাকায় ব্যাঙ্কের কেরানি, বৌ বাচ্চা পাঠিয়ে দিলো, না, ঢাকায় ফুটফাট লেগেই আছে, আর এসময়টা মেয়েরা মায়ের কাছেই ভালো থাকে। মায়ের কাছে আর রাখা গেলো কোথায়?

– আলা না করুক জোহরার যদি কিছু হয়! – জোহরার সম্ভাব্য বিপদের কথা মনে হলে মোবারক আলির নিয়ন্ত্রণহীন শরীর আরো এলিয়ে পড়তে চায়। শরীর সমলাবার উহ্য বাসনাতেই সে বলে, ‘যাই! চেয়ারম্যানের বাড়িত যাই। একটাই ব্যাটা! কয়টা দিন খুব ভুগলো গো! চেয়ারম্যানের বৌ এই কয়টা দিন একটা মিনিট ব্যাটার কাছ- ছাড়া হয় নাই। ব্যাটা ব্যাটা করা মনে হয় জান দিবি!’

এবার ডুকরে কেঁদে ওঠেল বুলুর মা। বলকানো কান্নার জন্য প্রথমদিকে তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিলো, কিছুক্ষণের মধ্যে কান্নার স্বর নিচে নামে এবং কথা স্পষ্ট হয়, ‘সেই কথায় তো কই গো, হামি সেই কথাই কই!’ কোন কথা তো শোনার জন্য মোবারক আলিকে আরো কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হয়, ‘দ্যাখো তো, চেয়ারম্যানের ব্যাটা, এ্যাঁ, তাঁই মরলো মায়ের সামনে, বাপের সামনে! মাও তো তার ব্যাটাক জান ভরা দেখ্যা লিবার পারল!

আর হামার বুলু কোটে কার গুলি খায়া মুখ থুবড়া পড়া মলো গো, ব্যাটার মুখকোনা হামি একবার দেখবারও পারলাম না গো! হামার বুলুর উপরে গজব পড়ে কিসক গো? বুলু অপঘাতত মরে কিসক গো?— এর জবাব দেয়া মোবারক আলির সাধ্যের বাইরে। বুলুর মায়ের এই বিলাপময় প্রশ্নের খাঁড়া থেকে ঘাড় বাঁচাবার জন্য এক্ষুণি তার বাইরে পালানো দরকার। কিন্তু দরজার ফাঁক দিয়ে বোঝা যায়, ফর্সা হতে এখনো বাকি। অন্ধকারে বাইরে বেরুলেই গুলি করে দেবে।

১০/১২ দিন আগে সরকার বাড়ির এক বর্গাদার চাষা পিঠে গুলি খেয়ে মরলো পানধোয়া বিলের ধারে। বিলের কাছে তহসিন সরকারের নাবা জমিতে লোকটা ঘর করে থাকে, তহসিন সরকারের জমিতেই বর্গা চাষ করে। রাত্রে বিলের ধারে পায়খানা করতে বসেছিলো, হাই স্কুলের ক্যাম্প থেকে গুলি করা হয়। পেটে গুলি লেগে লোকটা সঙ্গে সঙ্গে শেষ। তারপর হাই স্কুলের দপ্তরি নজীবুল- পিঠে গুলি লাগলো, সেও রাত্রেই। নজীবুলা গিয়েছিলো বেলকুচি হাটে।

মিলিটারি ক্যাম্প হাওয়ায় এদিককার হাটবাজার সব লাটে ওঠার অবস্থা, — গত বছরের সের পাঁচেক মরিচ ছিলো, তাই বিক্রি করতে নজীবুলার বেলকুচি যাওয়া। ফিরতে একটু রাত হয়েছিলো, রাত আর কত, এই এশার আজান দিয়েছে কি দেয়নি, স্কুলের সামনে দিয়ে সে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে তো মিলেটারি তাকে হুঙ্কার দিয়ে থামতে বলে। নজীবুলা থামবে কি, পড়িমরি করে দৌড় দেয় সামনের দিকে।

সঙ্গে সঙ্গে গুলি এসে লাগে তার পিঠে। মনে হয় গুলি লাগার পরেও লোকটা দৌড়েছিলো, তার লাশ পাওয়া যায় আমিনুদ্দিন সরকারের বাঁশঝাড়ের ভিতর। আমিনুদ্দিন সরকার ভাইপো তবারক, লাঠিডাঙার আয়নুল, পদুমশহরের হাশেম এন্ডল, হাই স্কুলের অঙ্ক স্যার নুর মোহাম্মদ— এদের মারা হয়েছে লাইনে দাঁড় করিয়ে, স্কুল দালানের পিছনে, ছোটো ক্লাসের ছেলেরা যেখানে দাড়িয়াবান্ধা, গোলাছুট, হাডুডু খেলতো সেখানে এদের পুতে রাখা হয়েছে।

বিলের ধারে লাশ, বাঁশঝাড়ে লাশ, স্কুলের পিছনে লাশ, . তাইতো একটা মাস যতোগুলো মানুষ পড়লো সবকটা গুলি খেয়ে মরছে । — সব্বাই ! তাই তো! — সকলের অপঘাত মৃত্যু। এমনকি পুব অঞ্চলে বিয়ে হয়েছে তার খালাতো বোন আমেনাবুবুর, সে মেলা দূর, যমুনার তীরে কেষটিয়া গ্রাম, প্রত্যেক বছর বর্ষাকাল আসে আর তারা নদীভাঙার ভয়ে তটস্থ হয়ে ওঠে; এবার এসেছে নদীর বাপ মিলিটারি।

আমেনাবুবুর দেওরের ছেলে আলি আকবর, চন্দনবাইসা কলেজে আই. কম পড়ে, তাকে গুলি করে ফেলে দিয়েছে যমুনায়। চন্দনবাইসা তহশীলদার অফিসে মিলিটারি ক্যাম্পের সামনে ছেলেটা ধরা পড়ে, তার কাছে অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিলো। আহা, বেচারা বংশের একমাত্র ছেলে, ঐ বাড়িতে আর সবকটা মেয়ে, ছেলেটাকে খুব কষ্ট দিয়ে মেরেছে। না, না, বুলুকে কিন্তু কষ্ট দেওয়ার সুযোগ পায়নি।

ধরা পড়ার আগেই ও গুলি খায়। সেই অজ্ঞাত জায়গায় অশ্রুত গুলির শব্দে মাথাটা দুলে ওঠে, হঠাৎ মনে হয়, তাইতো, কয়েক মাস এই এলাকায়, এমন কি কোন পুব অঞ্চলে কেষটিয়া গ্রাম, সেখানে পর্যন্ত— সবাই মারা গেছে গুলি খেয়ে। সব অপঘাতে মৃত্যু, স্বাভাবিকভাবে লোকে মরে না, গজব, আলার গজব, গজব না পড়লে মানুষের এরকম মৃত্যু হয়? চেয়ারম্যানের ভাগ্য! — তার ছেলেরই এমন স্বাভাবিক মরণ। এসব ভাগ্যের ব্যাপার।

চেয়ারম্যান লোকটার – সবদিকেই ভাগ্য ভালো, তার জমিতে ফসল হয় সবচেয়ে ভালো, যেবার যা বোনে সেবার তাতেই লাভ থাকে। ধান বলো, মরিচ বলো, . পেঁয়াজ বলো, আলু বলো চেয়ারম্যানের জমিতে যার ফলন ভালো সেই ফসলের সেবার দাম উঠবে। আবার দ্যাখো না, তিন তিনবার ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হলো, ইলেকশনে লোকটা কখনো হারে না। একমাত্র ছেলে, ছাত্র কতো ভালো, গত কয়েক বৎসর এই স্কুল থেকে তার মতো রেজাল্ট কেউ করতে পারেনি।

আবার দ্যাখো সবাই যখন এদিক ওদিক মরছে, চেয়ারম্যানের ছেলে তখন মায়ের কোলে দোল খেতে খেতে চোখ বুজে। এটা ভাগ্য ছাড়া কি? — দীর্ঘ নিশ্বাস চাপার জন্য মোবারক আলি একটু কাশে। আর বুলু কি সুন্দর ছেলে, আর কি রকম ঢ্যাঙা হয়ে ওঠেছিলো, তাই না? – মাথায় মোবারক আলিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো, ও ঠিক ওর দাদার মতো হতো, সেই – ছেলে, দিব্যি ভালো ছেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো, ৪ মাস পর খবর এলো যে সে গুলি খেয়ে মারা গেছে।

কোথায়? না, সে এখান থেকে মেলা দূর। একই জেলা, তবে সে হলো পুবের পলি এলাকা। হ্যাঁ, আমেনাবুবর শ্বশুর বাড়ির কাছেই হবে। গ্রামের নাম তার জানা নাই। দেড় মাস আগে বুলুর মরার খবর পেয়ে মোবারক ভেবেছিলো যে বৌয়ের কাছে খবরটা একেবারে চেপে যাবে। তো শোনার পর কয়েকটা ঘন্টা সে চুপ করেই ছিলো, তাও যে ছেলেটি খবর নিয়ে এসেছিলো তার বিশেষ অনুরোধে।

অনুরোধ না বলে আদেশ বলাই ঠিক, যাদের হাতে অস্ত্র থাকে তারা কি অনুরোধ করতে পারে? ছেলেটার নাম যেন কি? – না, নামটা মনে না করাই ভালো, বাড়ির কাছে মিলিটারি ক্যাম্প, কখন কে এসে ধমক দিলেই মোবারক আলি তার নাম ফাঁস করে দেবে। নাম মনে না থাকলে কি হয়, তার চেহারা প্রায় ২৪ ঘন্টা মোবারক আলির সামনে দোলে। ঘন কালো মেঘের সামনে শ্যামবর্ণ একখানা মুখ। ও যখন আসে তখন বিকালবেলা। খুব মেঘ করায় অন্ধকার হয়ে এসেছিলো।

মোবারক হাট থেকে ফিরছিলো পা চালিয়ে। এদিকে, এই ৫/৬/৭ মাইলের মধ্যে মিলিটারি ক্যাম্প তখনো হয়নি, তাই আকাশে জমাট মেঘ ছাড়া জোরে হাটার অন্য কোনো কারণ ছিলো না। ছেলেটিকে সে প্রথম দ্যাখে, বড়োমিয়ার আউশের জমির পাশে সাইকেল ঠেলে ঠেলে নালা পার হচ্ছিলো। তারপর সাইকেলে উঠে ছেলেটি তাদের গ্রামের দিকে চলে যায়।

পাকুড় গাছের তলায় এসে রাস্তা হঠাৎ বাক নিয়েছে, ছেলেটি সেখান থেকে আড়াল হয়ে পড়লো। তার দিকে মোবারক আলি ভালো করে লক্ষ্যও করেনি। হাটে শুনে এসেছে যে সেরপুর শহরে মিলিটারি ঢুকে বাড়িঘর তছনছ করে ফেলছে। তারপর বগুড়ায় নাকি মিলিটারির বিরাট আড্ডা।

বস্তুসংক্ষেপ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বগুড়া জেলার একটি ইউনিয়ন কাউন্সিলের কেরানি মোবারক আলীর কলেজ-পড়ুয়া ছেলে সুলতান ওরফে বুলু যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হয়। বুলুর জন্য পুত্রশোকাতুরা মা কাঁদতে পারে না, কারণ বাড়ির খুব কাছেই ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে বসেছে পাক মিলিটারিদের ক্যাম্প। এক রাত্রে কান্নার একটানা শব্দে মোবারক আলীর ঘুম ভেঙ্গে যায়।

গ্রাম পাহারা দিয়ে এসে মিলিটারি উচ্চকণ্ঠ কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলে কী জবাব দেবে, এই ভয়াকুল চিন্তায় বিমূঢ় মোবারক আলী একসময় বুঝতে পারে এ কান্না তার পুত্রশোকাতুর স্ত্রীর কান্না নয়; কান্নার শব্দটি মূলত আসছে পার্শ্ববর্তী চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে। মোবারক আলী নিশ্চিত হয় এ-কান্না চেয়ারম্যানের একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া। চেয়ারম্যানের মেধাবী ছেলে শাজাহান ছিলো মোবারকের পুত্র বুলুর স্কুল জীবনের সহপাঠী।

টাইফয়েডে আক্রান্ত শাজাহান যুদ্ধ কালীন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় ঐ রাতে। মিলিটারিদের সঙ্গে চেয়ারম্যানের সম্পর্ক যদিও খারাপ ছিলো না, তবু পুত্রের চিকিৎসার জন্য তাদের সাহায্য নিতে দ্বিধা ছিলো চেয়ারম্যানের। কারণ— ‘ঘরে সোমত্ত বয়সের মেয়ে আছে, কিসের বিনিময়ে কি চেয়ে বসে।’ চেয়ারম্যানের ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে বুলুর মায়ের পুত্রশোক উথলে ওঠে।

শঙ্কিত মোবারক স্ত্রীকে শান্ত হওয়ায় জন্য ধমক দেয় এভাবে, ‘কেন ছেলেকে আগলে রাখতে পারোনি, এখন হায় হায় করে লাভ কি?’ কিন্তু বুলুর মায়ের দুঃখটি ভিন্ন রকমের। শাজাহান অন্তত বাপ-মায়ের সামনে মরেছে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও তার মা প্রাণভরে ছেলের মুখ দেখে নিতে পেরেছে। কিন্তু তার বুলু কোথায় কার গুলি খেয়ে বিরান প্রান্তরে মুখ থুবরে পড়ে গেল, ‘অপঘাত মৃত্যু হলো কেন তার ছেলের?

মোবারক আলিও ছেলের মৃত্যুকে অপঘাত মৃত্যু হিসেবেই ধরে নিয়েছে। এতে অন্তত মুক্তিযোদ্ধা ছেলের কীর্তির পরিচয়টি গোপন থাকবে এবং সম্ভাব্য বিপদকেও এড়ানো যাবে। এসব এলোমেলো ভাবনার সূত্রে মোবারক- দম্পিতর মনে হয় প্রতিবেশী চেয়ারম্যান তাদের তুলনায় ভাগ্যবান, কেননা তাদের ছেলের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।

ভোরের আলো ফুটলে মোবারক চেয়ারম্যানের বাড়ি গিয়ে জানতে পারে, মৃত্যুর পূর্বে রোগ বিকারগ্রন্থ শাজাহান সারারাত ধরে বন্ধু বুলুর কথা বলেছে, বুলুর সঙ্গে চলে যাবার কথা বলেছে। মৃত্যুর পূর্বে বিকারাবস্থায় বুলুর জন্য শাজাহানের ব্যাকুলতা বুলুর মৃত্যুকে নতুন মূল্যে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে মোবারককে।

বুলু যুদ্ধে যাবার চারমাস পর একটি ছেলে বুলুর খবর নিয়ে এসেছিলো মোবারকের কাছে। ছেলেটি জানিয়েছিল, বুলুসহ ওরা তিনজন পাকসেনাদের গতি রোধ করার জন্য বৌ-ডোবা খালের ব্রিজের নিচে মাইন পুঁততে গিয়েছিলো। কেননা ব্রিজের এপাশে দেবডাঙায় তখন মুক্তিবাহিনীর সমাবেশ ঘটে চলেছে। মুক্তিবাহিনীর নিরাপত্তার স্বার্থেই ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজন ছিলো।

তারা যখন ব্রিজের নিচে মাইন পোঁতার কাজ শুরু করেছে ঠিক তখনই ওপাশ থেকে এগিয়ে আসা মিলিটারি জীপের আওয়াজ পেয়ে তারা দ্রুত পাটক্ষেতে লুকোয়। জীপ ব্রিজে উঠতেই বুলু পাটক্ষেত থেকে বেরিয়ে জীপকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়ে। লক্ষ্যভেদের সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারের পাশে বসা অফিসার ছিটকে ব্রিজ ডিঙিয়ে নিচে পড়ে যায়। জীপগাড়ি গড়াতে গড়াতে আটকে পড়ে খালের মুখে।

কিন্তু ওদের অলক্ষ্যে একজন পাকসৈনিক আগেই জীপ থেকে লাফিয়ে পড়েছিলো। মিলিটারিদের আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রগুলো সংগ্রহ করতে বুলু ও তার একজন সহযোদ্ধা জীপের কাছে যাবার জন্যে রাস্তায় উঠে আসতেই ঐ সৈনিকটি গুলি ছুড়লে দুটি গুলি ঝাঁঝরা করে দেয় বুলুর বুক; ঘটনাস্থলেই শহীদ হন বুলু। শাজাহানের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে বুলুর মৃত্যুর ঘটনা স্মরণ করে মোবারক আপুত হয়ে ওঠে, বুলুর আত্মবলিদানকে নতুন মূল্যে গ্রহণ করে সে।

মিলিটারি ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন চেয়ারম্যানকে ডেকে নিয়ে শাজাহানের লাশ দ্রুত দাফনের নির্দেশ দেয়। ক্যাম্পের সামনে দিয়ে লাশ নিয়ে গোরস্থানে যেতে বাধা দেয় কর্তব্যরত সেপাইরা। শরতের প্রারম্ভের ঘটনা হলেও বর্ষার জল তখনো সরে যায়নি মাঠঘাট থেকে। অন্যকোন রাস্তা ধরে গোরস্থানে যাবার পথও তাই বন্ধ।

এরকম একটি অস্বস্তিকর পরিবেশে অশিক্ষিত কৃষক কাবেজ বলে যে চেয়ারম্যান যদি শাজাহানকে বুলুর সঙ্গে যেতে দিত তাহলে তাকে ছেলের লাশ নিযে এমন বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। সে এখন থাকতো মুক্তিসেনাদের কড়িতল থানা বিজয়-অভিযানে। মোবারক ভাবে কাবেজ জানে না যে, মিলিটারি জীপে গ্রেনেড ছুড়ে কতগুলো মিলিটারিকে খতম করে বুলুর আত্মবলিদানের কথা। বুলুর মৃত্যুর ঘটনা কাবেজকে বলতে ইচ্ছে করে মোবারকের।

অনেক কষ্টে জল-কাদা ডিঙিয়ে শাজাহানের লাশ দাফনের পর চেয়ারম্যান বাড়ির উঠোনে কাবেজ মোবারককে বলে, ‘দ্যাখেন তো চাচা মিয়া, অলেয্য কথাটা হামি কি কনু কনতো? তখন বুলুর সাথে গেলে শাজাহানের আজ বলে এত দুক্ষু পোয়ান লাগে? শালারা অর সাথে এত জুলুম করব্যার পারে? শেষে গলা নামিয়ে কাবেজ মোবারকের কাছে জানতে চায় বুলু কড়িতলা অভিযানে এসেছিলো কি না।

এবারে মোবারক আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না, কাবেজের নিচু স্বরকে উপেক্ষা করে স্বাভাবিক গলাতেই ছেলের বীরত্বপূর্ণ মৃত্যুর কাহিনী শুনিয়ে দেয় সে কাবেজকে। সন্ধ্যায় জুম্মা ঘরের বারান্দায় ইমাম-কাম-মোয়াজ্জেনকে প্রথমে বানিয়ে বানিয়ে কড়িতলা সংঘর্ষের গল্প বলে মোবারক, শেষে শোনায় ছেলে বুলুর প্রকৃত বীরত্বের কাহিনী।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসা সত্ত্বেও বাড়ি ফিরতে দেরী দেখে বুলুর মা ভয়ে আতঙ্কে প্রতীক্ষা করে মোবারকের। স্ত্রীর ওই দুশ্চিন্তা দেখে পুত্রগৌরবে গৌরবিত মোবারক বিরক্ত বোধ করে। তার মনে হয় ‘যার ছেলে মারা গেছে মাস দুয়েকও হয়নি, সেই মা অন্য কারণে উতলা হয় কিভাবে? সন্ধ্যার পর ছেলের জন্য হামলে কেঁদে মা যদি সারা গ্রাম মাথায় না তুললো তো বুলু এরকম মরা মরতে গেছে কোন দুঃখে?”

 

অপঘাত ছোটগল্প

 

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের উত্তর লিখুন

১. রাতে একটানা কান্নার শব্দ শুনে মোবারকের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো?

২. সেপাই সাহেবের সম্ভাব্য প্রশ্নের কী উত্তর ভেবে রেখেছিলেন মোবারক?

৩. শাজাহানের চিকিৎসা-সহায়তা না-পাওয়ার কারণ কী?

৪. ‘রাত্রিবেলা এ ঘরের ভূগোল মোবারকের মুখস্থ।’ – কোন্ প্রসঙ্গে এই মনোভাবটি ব্যক্ত

৫. মোবারকের ভাবনার অনুসরণে টর্চার সেলের বর্ণনা দিন ।

৬. মিলিটারি ক্যাম্প বসার পর গ্রামীণ জনজীবনের অবস্থা বর্ণনা করুন।

৭. বুলুর মৃত্যু সংবাদ বহন করে আনার ঘটনাটি বর্ণনা করুন।

৮. বুলুর মৃত্যুদৃশ্য বর্ণনা করুন।

৯. মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বুলুর প্রসঙ্গে কী অভিযোগ উত্থাপন করেছিলো চেয়ারম্যান?

১০. শাজাহানের মরদেহ দাফনের সময় কী ঘটনা ঘটেছিলো?

আরও দেখুন :

 

Leave a Comment