প্রাগৈতিহাসিক ছোটগল্প

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় প্রাগৈতিহাসিক ছোটগল্প

প্রাগৈতিহাসিক ছোটগল্প

 

প্রাগৈতিহাসিক ছোটগল্প

 

প্রাগৈতিহাসিক ছোটগল্প

লেখক-পরিচিতি

১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের সাঁওতাল পরগনা জেলার দুমকা শহরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়, জননী নীরদাসুন্দরী দেবী। মানিকের পিতৃ-মাতৃ উভয় পক্ষেরই নিবাস ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার, ডাক নাম ছিল মানিক।

কিন্তু লেখক-নাম ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গ্রহণযোগ্যতার কাছে প্রবোধকুমার নামটি অন্তরালে চলে যায় এক সময়। পিতৃপক্ষের আদি নিবাস বাংলাদেশে হলেও সেটেলমেন্ট বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার পিতার সরকারি চাকুরির কারণেই মানিকের বাল্যকাল অতিবাহিত হয় তৎকালীন পূর্ব বাংলা, পশ্চিম বাংলা এবং বিহার রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে। ফলে বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পরিব্যাপ্ত তাঁর অসমাপ্ত শিক্ষাজীবন।

মানিক ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে অংক পরীক্ষায় লেটারসহ ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আই.এস.সি পরীক্ষা দেন বাঁকুড়ার ওয়েসলিয় মিশন কলেজ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এবং এ-পরীক্ষাতেও তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগ লাভ করেন। এরপর মেধাবী ছাত্র মানিক অংকশাস্ত্রে অনার্সসহস্রাতক হবেন এই প্রত্যাশায় কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন ।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই তিনি সাহিত্যজগতের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন নিজেকে। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে এ- সময়েই তিনি রচনা করেন তাঁর প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’। গল্পটি ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের বিচিত্রা পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় ছাপা হওয়ার পর থেকেই মানিক ক্রমশ সার্বক্ষণিক লেখকে পরিণত হন। ফলত প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন করে বিজ্ঞানী হওয়ার আশা ছাড়তে হয় তাঁকে। দুবার বি.এস.সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও কৃতকার্য হতে পারেন নি।

পরবর্তী পর্যায়ে তিনি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম দুটি উপন্যাস জননী (১৯৩৫) ও দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫) প্রকাশিত হয়। এর অত্মকাল পরেই তাঁর দুটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬) ও পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬) প্রথমে ভারতবর্ষ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এবং পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণেই চলিশের দশক থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ক্রমশ মার্কসবাদের প্রতি আস্থাশীল হয়ে পড়েন।

এরই ক্রমধারায় ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি লাভ করেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ। তাঁর প্রথম পর্যায়ের রচনায় ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ-তত্ত্ব ও নিয়তিবাদ প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। কিন্তু পার্টি সভ্যপদ প্রাপ্তির পরের রচনাগুলিতে মুখ্যস্থান জুড়ে গেল সমাজ ও মানুষের প্রতি প্রতিশ্রুতির প্রেরণা। তবু শিল্পমূল্য ও রসাবেদনগত দিক থেকে প্রথম পর্যায়ের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ই উজ্জ্বলতর। প্রথম পর্বে রচিত শ্রেষ্ঠ রচনাগুলিই বাংলা কথাসাহিত্যের চিরায়ত সম্পদ রূপে গৃহীত ।

১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ময়মনসিংহ সরকারি গুরু ট্রেনিং বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা কমলাদেবীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। প্রথানুগ কর্মময় জীবনে আত্মনিয়োগের ক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগ সর্বদা ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বঙ্গশ্রী পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের পদে যোগদান করেন। কিন্তু মাত্র দুবছরের মাথায় তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন।

অনুজ সুবোধকুমারকে নিয়ে মানিক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি প্রকাশনালয়। কিন্তু এটিও স্থায়ী হয়নি। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ন্যাশনাল ওয়ার ফ্রন্টের প্রভিন্সিয়াল অর্গানাইজার দপ্তরে পাবলিসিটি অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরি করেন ১৯৪৩-এর জুন অবধি। পার্টি সভ্যপদ লাভের পর মুখ্যত লেখালেখি ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মধ্যেই নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন মানিক।

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পূর্ববঙ্গ প্রগতি লেখক ও শিল্পী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি নির্বাচিত হন প্রগতি লেখক সংঘের যুগ্ম সম্পাদক-এর পদে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ঐক্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে মানিক সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর শেষ জীবন সীমাহীন অর্থকষ্ট ও মৃত্যুমুখী ব্যাধির যন্ত্রণার মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হয়।

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত কালজয়ী কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর জীবনাবসান ঘটে। উপন্যাস ও ছোটগল্প – কথাসাহিত্যের এই দুধারাতেই অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রচুর রচনা বাংলা চিরায়ত কথাসাহিত্যের সম্পদ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ-

উপন্যাস: জননী (১৯৩৫), দিবারাত্রির কাব্য (১৯৩৫), পুতুল নাচের ইতিকথা (১৯৩৬), পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬), অহিংসা (১৯৪১), চতুষ্কোণ (১৯৪২), চিহ্ন (১৯৪৭), জীয়ন্ত (১৯৫০), স্বাধীনতার স্বাদ (১৯৫০)। ছোটগল্পঃ অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প (১৯৩৫), প্রাগৈতিহাসিক (১৯৩৭), মিহি ও মোটা কাহিনী (১৯৩৮) সরীসৃপ (১৯৩৯), বৌ (১৯৪০), সমুদ্রের স্বাদ (১৯৪৩), আজ কাল পরশুর গল্প (১৯৪৬), ছোট বকুলপুরের যাত্রী (১৯৪৯)।

নাটক: ভিটেমাটি (১৯৪৬)।

কবিতা: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা (১৯৭০)।

প্রবন্ধ: লেখকের কথা (১৯৫৭)।

পাঠ-পরিচিতি

‘প্রাগৈতিহাসিক’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর শ্রেষ্ঠ গল্পগুলির অন্যতম। মানুষের আদিম প্রবৃত্তির রূপায়ণ-দক্ষতা, আকাড়া বাস্তবতা ও পরিণতির দার্শনিকতামন্ডিত ব্যঞ্জনা গল্পটির শ্রেষ্ঠত্বের উৎস। প্রাগৈতিহাসিক গল্পগ্রন্থের নামগল্প ‘প্রাগৈতিহাসিক’। কলকাতার গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যাণ্ড সন্স থেকে প্রকাশিত এ-গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে প্রকাশকাল উলেখ ছিল না। প্রাগৈতিহাসিক-এর প্রকাশকাল এপ্রিল ১৯৩৭ বলে গবেষকরা অনুমান করেন।

প্রাগৈতিহাসিক-সহ মোট দশটি গল্প গ্রন্থটিতে সংকলিত হয়। গল্পগুলি হচ্ছে-‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘চোর’, ‘মাটির সাকী’, ‘যাত্রা’, ‘প্রকৃতি’, ‘ফাঁসি’, ‘ভূমিকম্প’, ‘অন্ধ’, ‘চাকুরী’, ‘মাথার রহস্য’। তবে ‘মাটির সাকী’ গল্পটি ইতোপূর্বে প্রকাশিত ‘অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সর্বদর্শী লেখকের ভাষ্যে উপস্থাপিত ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটি সাধু ভাষারীতিতে লিখিত। এখানে গত্মকারের ভূমিকা যেহেতু সর্বদর্শীর, সেহেতু গল্পের কথাবস্তুর মধ্যদিয়ে সৃজয়িতার জীবনদর্শন সুস্পষ্টভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পগ্রন্থের রচনাপর্বে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন দৃষ্টিতে অন্ধ-নিয়তিচেতনা ও ফ্রয়েডয় লিবিডোতত্ত্বের প্রভাব ছিল।

‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের নায়ক ভিখুর চরিত্রে আদিম প্রবৃত্তিতাড়না, অন্ধ নিয়তির আধিপত্য বিস্তার এবং অস্তিত্বরক্ষা তথা প্রবল জীবনানুরাগ পরিস্ফুট হয়েছে। তবে গল্পের শেষ অনুচ্ছেদে লেখকের ভাষ্যে পাঁচীকে কাঁধে নিয়ে ভিখুর পথযাত্রার বর্ণনায় আদিম অথচ অনিঃশেষ মানবিক প্রবৃত্তিতাড়নার নিরঙ্কুশ আধিপত্যের কথাই প্রধান হয়ে উঠেছে।

মূলপাঠ

সমস্ত বর্ষাকালটা ভিখু ভয়ানক কষ্ট পাইয়াছে। আষাঢ় মাসের প্রথমে বসন্তপুরের বৈকুণ্ঠ সাহার গদীতে ডাকাতি করিতে গিয়া তাহাদের দল ধরা পড়িয়া যায়। এগার জনের মধ্যে কেবল ভিখুই কাঁধে একটা বর্ণার খোচা খাইয়া পলাইতে পারিয়াছিল। রাতারাতি দশ মাইল দূরের মাথাভাঙ্গা পুলটার নীচে পৌঁছিয়া অর্ধেকটা শরীর কাদায় ডুবাইয়া শরবনের মধ্যে দিনের বেলাটা লুকাইয়া ছিল। রাত্রে আরো ন’ক্রোশ পথ হাঁটিয়া একেবারে পেহ্লাদ বাগ্দীর বাড়ী চিতলপুরে।

পেহ্লাদ তাহাকে আশ্রয় দেয় নাই ।

কাঁধটা দেখাইয়া বলিয়াছিল, ‘ঘাও খান সহজ লয় স্যাঙ্গাৎ। উটি পাকবো। গা ফুলবো। জানাজানি হইয়া গেলে আমি ক’নে যামু? খুনটা যদি না করতিস্ – ‘*তরেই খুন করতে মন লইতেছে পেহ্লাদ।’

‘এই জনমে লা, স্যাঙ্গাৎ।’

বন কাছেই ছিল, মাইল পাঁচেক উত্তরে। ভিখু অগত্যা বনেই আশ্রয় লইল। পেহ্লাদ নিজে বাঁশ কাটিয়া বনের একটা দুর্গম অংশে সিনজুরি গাছের নিবিড় ঝোপের মধ্যে তাহাকে একটা মাচা বাঁধিয়া দিল। তালপাতা দিয়া একটা আচ্ছাদনও করিয়া দিল। বলিল, ‘বাদলায় বাঘটাঘ সব পাহাড়ের উপরে গেছে গা। সাপে যদি না কাটে ত আরাম কইরাই থাকবি ভিখু।’

‘খামু কি?’

“চিড়া-গুড় দিলাম যে? দুদিন বাদে ভাত লইয়া আসুম; রোজ আইলে মাইনষে সন্দ করব।’
কাঁধের ঘাটা লতাপাতা দিয়া বাঁধিয়া আবার আসিবার আশ্বাস দিয়া পেহ্লাদ চলিয়া গেল। রাত্রে ভিখুর জ্বর আসিল। পরদিন টের পাওয়া গেল পেহ্লাদের কথাই ঠিক, কাঁধের ঘা ভিখুর দুনাইয়া উঠিয়াছে। ডান হাতটি ফুলিয়া ঢোল হইয়া গিয়াছে এবং হাতটি তাহার নাড়িবার সামর্থ্য নাই।

বর্ষাকালে যে বনে বাঘ বাস করিতে চায় না এমনি অবস্থায় সেই বনে জলে ভিজিয়া মশা ও পোকার উৎপাত সহিয়া, দেহের কোন না কোন অংশ হইতে ঘণ্টায় একটি করিয়া জোঁক টানিয়া ছাড়াইয়া জ্বরে ও ঘায়ের ব্যথায় ঝুঁকিতে ঝুঁকিতে ভিখু দুদিন দুরাত্রি সঙ্কীর্ণ মাচাটুকুর উপর কাটাইয়া দিল। বৃষ্টির সময় ছাট লাগিয়া সে ভিজিয়া গেল, রোদের সময় ভাসা গাঢ় গুমোটে সে হাঁপাইয়া হাঁপাইয়া শ্বাস টানিত, পোকার অত্যাচারে দিবারাত্রি তাহার এক মুহূর্তের স্বস্তি রহিল না।

পেহ্লাদ কয়েকটা বিড়ি দিয়া গিয়াছিল, সেগুলি ফুরাইয়া গিয়াছে। তিন-চারদিনের মত চিঁড়া আছে বটে কিন্তু গুড় একটুও নেই। গুড় ফুরাইয়াছে, কিন্তু গুড়ের লোভে যে লাল পিঁপড়াগুলি ঝাক বাঁধিয়া আসিয়াছিল তাহারা এখনো মাচার উপরে ভিড় করিয়া আছে। ওদের হতাশার জ্বালা ভিখুই অবিরত ভোগ করিতেছে সর্বাঙ্গে।

মনে মনে পেহ্লাদের মৃত্যু কামনা করিতে করিতে ভিখু তবু বাঁচিবার জন্য প্রাণপণে যুঝিতে লাগিল, যেদিন পেহ্লাদের আসিবার কথা সেদিন সকালে কলসীর জলটাও তাহার ফুরাইয়া গেল। বিকাল পর্যন্ত পেহ্লাদের জন্য অপেক্ষা করিয়া তৃষ্ণার পীড়ন আর সহিতে না পারিয়া কলসীটা লইয়া যে সে কত কষ্টে খানিক দূরের নালা হইতে আধ কলসী জল ভরিয়া আনিয়া আবার মাচায় উঠিল তাহার বর্ণনা হয় না; অসহ্য ক্ষুধা পাইলে চিড়া চিবাইয়া সে পেট ভরাইল।

এক হাতে ক্রমাগত পোকা ও পিপড়াগুলি টিপিয়া মারিল। বিষাক্ত রস শুষিয়া লইবে বলিয়া জোঁক ধরিয়া নিজেই ঘায়ের চারিদিকে লাগাইয়া দিল। সবুজ রঙের একটা সাপকে একবার মাথার কাছে সিজুরি গাছের পাতার ফাঁকে উকি দিতে দেখিয়া পুরা দুঘণ্টা প্রাগৈতিহাসিক ছোটগল্প  লাঠি হাতে সেদিকে চাহিয়া রহিল এবং তাহার পর দুএক ঘণ্টা অন্তরই চারিদিকে ঝোপে ঝপাঝপ লাঠির বাড়ি দিয়া মুখে যথাসাধ্য শব্দ করিয়া সাপ তাড়াইতে লাগিল ।

মরিবে না। সে কিছুতেই মরিবে না। বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না সেই অবস্থায়, মানুষ সে, বাঁচিবেই। পেহ্লাদ গ্রামান্তরে কুটুমের বাড়ী গিয়াছিল। পরদিনও সে আসিল না। কুটুম বাড়ীর বিবাহোৎসবে তাড়ি টানিয়া বেহুস হইয়া পাড়িয়া রহিল। বনের মধ্যে ভিখু কি ভাবে দিন-রাত্রি কাটাইতেছে তিন দিনের মধ্যে সে কথা একবার মনেও পড়িল না । ইতিমধ্যে ভিখুর ঘা পচিয়া উঠিয়া লালচে রস গড়াইতে আরম্ভ করিয়াছে।

শরীরও তাহার অল্প অল্প ফুলিয়াছে। জ্বরটা একটু কমিয়াছে কিন্তু সর্বাঙ্গের অসহ্য বেদনা দম ছুটানো তাড়ির নেশার মতোই ভিখুকে আচ্ছন্ন, অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে। সে আর এখন ক্ষুধা তৃষ্ণা অনুভব করিতে পারে না। জোঁকেরা তাহার রক্ত শুষিয়া শুষিয়া কচি পটোলের মত ফুলিয়া উঠিয়া আপনা হইতেই নীচে খসিয়া পড়িয়া যায়, সে টেরও পায় না।

পায়ের ধাক্কায় এক সময় জলের কলসীটা নীচে পড়িয়া ভাঙ্গিয়া যায়, বৃষ্টির জলে ভিজিয়া পুঁটলির মধ্যে চিঁড়াগুলি পচিতে আরম্ভ করে, রাত্রে তাহার ঘায়ের গন্ধে আকৃষ্ট হইয়া মাচার আশেপাশে শিয়াল ঘুরিয়া বেড়ায়। কুটুমবাড়ী হইতে ফিরিয়া বিকালের দিকে ভিখুর খবর লইতে গিয়া ব্যাপার দেখিয়া পেহ্লাদ গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িল। ভিখুর জন্য একবাটি ভাত ও কয়েকটি পুঁটিমাছ ভাজা আর একটু পুঁইচচ্চড়ি সে সঙ্গে লইয়া গিয়াছিল।

সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিখুর কাছে বসিয়া থাকিয়া ওগুলি সে নিজেই খাইয়া ফেলিল। তারপর বাড়ি গিয়া বাঁশের একটা ছোট মই এবং তাহার বোনাই ভরতকে সঙ্গে করিয়া ফিরিয়া আসিল। মই-এ শোয়াইয়া তাহারা দুজনে ভিখুকে বাড়ী লইয়া গেল। ঘরের মাচার উপরে খড় বিছাইয়া শয্যা রচনা করিয়া তাহাকে শোয়াইয়া রাখিল।

আর এমনি শক্ত প্রাণ ভিখুর যে শুধু এই আশ্রয়টুকু পাইয়াই বিনা চিকিৎসায় ও একরকম বিনা যত্নেই একমাস মুমূর্ষু অবস্থায় কাটাইয়া সে ক্রমে ক্রমে নিশ্চিত মরণকে জয় করিয়া ফেলিল। কিন্তু ডান হাতটি তাহার আর ভাল হইল না। গাছের মরা ডালের মত শুকাইয়া গিয়া অবশ অকর্মণ্য হইয়া পড়িল। প্রথমে অতি কষ্টে হাতটা সে একটু নাড়িতে পারিত কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ক্ষমতাটুকুও তাহার নষ্ট হইয়া গেল।

কাঁধের ঘা শুকাইয়া আসিবার পর বাড়ীতে বাহিরের লোক কেহ উপস্থিত না থাকিলেও ভিখু তাহার একটিমাত্র হাতের সাহায্যে মধ্যে মধ্যে বাঁশের মই বাহিয়া নীচে নামিতে লাগিল এবং একদিন সন্ধ্যার সময় এক কাণ্ড করিয়া বসিল। পেহ্লাদ সে সময় বাড়ী ছিল না, ভরতের সঙ্গে তাড়ি গিলিতে বাহির হইয়া গিয়াছিল। পেহ্লাদের বোন গিয়াছিল ঘাটে। পেহ্লাদের বৌ ছেলেকে ঘরে শোয়াইয়া আসিয়া ভিখুর চাহনি দেখিয়া তাড়াতাড়ি পলাইয়া যাইতেছিল ভিখু তাহার একটা হাত চাপিয়া ধরিল।

কিন্তু পেহ্লাদের বৌ বাগ্দীর মেয়ে! দুর্বল শরীরে বাঁ হাতে তাহাকে আয়ত্ত করা সহজ নয়। এক ঝটকায় হাত ছাড়াইয়া সে গাল দিতে দিতে চলিয়া গেল। পেহ্লাদ বাড়ী প্রাগৈতিহাসিক ছোটগল্প  ফিরিলে সব বলিয়া দিল। তাড়ির নেশায় পেহ্লাদের মনে হইল, এমন নেমকহারাম মানুষটাকে একেবারে খুন করিয়া ফেলাই কর্তব্য। হাতের মোটা বাঁশের লাঠিটা বৌ এর পিঠে এক ঘা বসাইয়া দিয়া ভিখুর মাথা ফাটাইতে গিয়া নেশার মধ্যেও কিন্তু টের পাইতে তাহার বাকী রহিল না যে কাজটা যত বড় কর্তব্যই হোক সম্ভব একেবারেই নয়।

ভিখু তাহার ধারাল দাটি বাঁ হাতে শক্তি করিয়া বাগাইয়া ধরিয়া আছে। সুতরাং খুনোখুনির পরিবর্তে তাহাদের মধ্যে কিছু অশীল কথার আদান প্রদান হইয়া গেল । শেষে পেহ্লাদ বলিল, ‘তোর লাইগ্যা আমার সাত টাকা খরচ গেছে, টাকাটা দে, দিয়া বাইর, আমার বাড়ী থেইকা দূর হ’।
ভিখু বলিল ‘আমার কোমরে একটা বাজু বাইন্ধা রাখছিলাম, তুই চুরি করছস। আগে আমার বাজু ফিরাইয়া দে, তবে যামু’ ।

‘তোর বাজুর খবর জানে কেডারে?’

‘বাজু দে কইলাম পেহ্লাদ, ভাল চাস ত! বাজু না দিলি সাবাড়ীর মেজো কত্তার মত গলাডা তোর একখান কোপেই দুই ফাঁক কইরা ফেলুম এই তোরে আমি কইয়া রাখলাম। বাজু পালি’ আমি এখনি যামু গিয়া।’ কিন্তু বাজু ভিখু ফেরত পাইল না। তাহাদের বিবাদের মধ্যে ভরত আসিয়া পড়ায় দুজনে মিলিয়া ভিখুকে তাহারা কায়দা করিয়া ফেলিল। পেহ্লাদের বাহুমূলে একটা কামড় বসাইয়া দেওয়া ছাড়া দুর্বল ও পঙ্গু ভিখু আর বিশেষ কিছুই করিয়া উঠিতে পারিল না।

পেহ্লাদ ও তাহার বোনাই তাহাকে মারিতে মারিতে আধমরা করিয়া ফেলিয়া বাড়ীর বাহির করিয়া দিল। ভিখুর শুকাইয়া আসা ঘা ফাটিয়া রক্ত পড়িতেছিল, হাত দিয়া রক্ত মুছিতে মুছিতে ঝুঁকিতে ঝুঁকিতে সে চলিয়া গেল। রাত্রির অন্ধকারে সে কোথায় গেল কেহই তাহা জানিতে পারিল না বটে, কিন্তু দুপুর রাতে পেহ্লাদের ঘর জ্বলিয়া উঠিয়া বাগ্দীপাড়ায় বিষম হৈ চৈ বাধাইয়া দিল।

সর্বনাশ!

পেহ্লাদ কপাল চাপড়াইয়া বলিতে লাগিল, ‘হায় সর্বনাশ, হায় সর্বনাশ! ঘরকে আমার শনি আইছিলো, হায় কিন্তু পুলিশের টানাটানির ভয়ে মুখ ফুটিয়া বেচারা ভিখুর নামটা পর্যন্ত করিতে পারিল না। সেই রাত্রি হইতে ভিখুর আদিম, অসভ্য জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হইল। চিতলপুরের পাশে একটা নদী আছে। পেহ্লাদের ঘরে আগুন দিয়া আসিয়া একটা গোল ডিঙ্গি চুরি করিয়া ভিখু নদীর স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছিল। লগি ঠেলিবার সামর্থ্য তাহার ছিল না।

একটা চ্যাপটা বাঁশকে হালের মত করিয়া ধরিয়া রাখিয়া সে সমস্ত রাত কোন রকমে নৌকার মুখ সিধা রাখিয়াছিল। সকাল হওয়ার আগে শুধু স্রোতের টানে সে বেশীদূর আগাইতে পারে নাই। ভিখুর মনে আশঙ্কা ছিল ঘরে আগুন দেওয়ার শোধ লইতে পেহ্লাদ হয় ত তাহার নামটা প্রকাশ করিয়া দিবে, মনের জ্বালায় নিজের অসুবিধাটার কথা ভাবিবে না। পুলিশ বহু দিন যাবত তাহাকে ধরিবার চেষ্টা করিতেছে, বৈকুণ্ঠ সাহার বাড়ীতে খুনটা হওয়ার ফলে চেষ্টা তাহাদের বাড়িয়াছে বই কমে নাই।

পেহ্লাদের কাছে খবর পাইলে পুলিশ আশেপাশে চারিদিকেই তাহার খোঁজ করিবে। বিশ ত্রিশ মাইলের মধ্যে লোকালয়ে মুখ দেখানো তাহার পক্ষে বিপদের কথা। কিন্তু ভিখু তখন মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে। কাল বিকাল হইতে সে কিছু খায় নাই। দুজন যোয়ান মানুষের হাতে বেদম মার খাইয়া এখনো দুর্বল শরীরটা তাহার ব্যথায় আড়ষ্ট হইয়া আছে। ভোর ভোর মহকুমা শহরের ঘাটের সামনে পৌছিয়া সে ঘাটে নৌকা লাগাইল।

নদীর জলে ডুবিয়া ডুবিয়াস্নান করিয়া গায়ের রক্তের চিহ্ন ধুইয়া ফেলিয়া শহরের ভিতরে প্রবেশ করিল। ক্ষুধায় সে চোখে অন্ধকার দেখিতেছিল। একটি পয়সাও তাহার সঙ্গে নাই যে মুড়ি কিনিয়া খায়। বাজারের রাস্তায় প্রথম যে ভদ্র লোকটির সঙ্গে দেখা হইল তাহারই সামনে হাত পাতিয়া সে বলিল, ‘দুটো পয়সা দিবান কর্তা?

তাহার মাথায় জটবাঁধা চাপ চাপ রুক্ষ ধূসর চুল কোমরে জড়ানো মাটির মত ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া, আর দড়ির মত শীর্ণ দোদুল্যমান হাতটি দেখিয়া ভদ্রলোকের বুঝি দয়াই হইল। তিনি তাহাকে একটি পয়সা দান করিলেন। ভিখু বলিল – ‘একটা দিলেন বাবু? আর একটা দেন।’
ভদ্রলোক চটিয়া বলিলেন, — একটা দিলাম, তাতে হল না, ভাগ্‌।’

এক মুহূর্তের জন্য মনে হইল ভিখু বুঝি তাহাকে একটা বিশ্রী গালই দিয়া বসে। কিন্তু সে আত্মসম্বরণ করিল। গাল দেওয়ার বদলে আরক্ত চোখে তাহার দিকে একবার কটমট করিয়া তাকাইয়া সামনের মুড়িমুড়কির দোকানে গিয়া পয়সাটা দিয়া মুড়ি কিনিয়া গোগ্রাসে গিলিতে আরম্ভ করিল। সেই হইল তাহার ভিক্ষা করিবার হাতে খড়ি। কয়েক দিনের ভিতরেই সে পৃথিবীর বহু পুরাতন ব্যবসাটির এই প্রকাশ্যতম বিভাগের আইন কানুন সব শিখিয়া ফেলিল।

 

প্রাগৈতিহাসিক ছোটগল্প

 

আবেদনের ভঙ্গি ও ভাষা তাহার জন্ম ভিখারীর মত আয়ত্ত হইয়া গেল। শরীর এখন আর সে একবারেই সাফ্ করে না। মাথার চুল ক্রমেই তাহার জট বাঁধিয়া বাঁধিয়া দলা দলা হইয়া যায় এবং তাহাতে অনেকগুলি উকুন পরিবার দিনের পর দিন বংশ বৃদ্ধি করিয়া চলে। ভিখু মাঝে মাঝে খ্যাপার মত দুই হাতে মাথা চুলকায় কিন্তু বাড়তি চুল কাটিয়া ফেলিতে ভরসা পায় না।

ভিক্ষা করিয়া সে একটি ছেঁড়া কোট পাইয়াছে, কাঁধের ক্ষত চিহ্নটা ঢাকিয়া রাখিবার জন্য দারুণ গুমোটের সময়েও সে কোটটা গায়ে চাপাইয়া রাখে। শুকনো হাতখানা তাহার ব্যবসার সবচেয়ে জোরালো বিজ্ঞাপন। এই অঙ্গটি ঢাকিয়া রাখিলে তাহার চলে না। কোটের ডানদিকের হাতাটি তাই সে বগলের কাছ হইতে ছিঁড়িয়া বাদ দিয়াছে। একটি টিনের মগ্ন ও একটি লাঠিও সে সংগ্রহ করিয়া লইয়াছে।

সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাজারের কাছে রাস্তার ধারে একটা তেঁতুল গাছের নীচে বসিয়া সে ভিক্ষা করে। সকালে এক পয়সার মুড়ি খাইয়া নেয়, দুপুরে বাজারের খানিকটা তফাতে একটা পোড়ো বাগানের মধ্যে ঢুকিয়া বটগাছের নীচে ইটের উনুনে মেটে হাঁড়িতে ভাত রান্না করে, মাটির মালসায় কোনদিন রাঁধে ছোট মাছ, কোনদিন তরকারী। পেট ভরিয়া খাইয়া বটগাছটাতেই হেলান দিয়া আরামে বিড়ি টানে। তারপর আবার তেঁতুল গাছটার নীচে গিয়া বসে।

সারাটা দিন শ্বাসটানা শ্বাসটানা কাতরানির সঙ্গে সে বলিয়া যায়: ‘হেই বাবা একটা পয়সা : আমায় দিলে

ভগবান দিবে : হেই বাবা একটা পয়সা।’

অনেক প্রাচীন বুলির মত ‘ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ’ শোকটা আসলে অসত্য। সারাদিন ভিখুর সামনে দিয়ে হাজার দেড় হাজার লোক যাতায়াত করে এবং গড়ে প্রতি পঞ্চাশ জনের মধ্যে একজন তাহাকে পয়সা অথবা আধলা দেয়। আধলার সংখ্যা বেশী হইলেও সারাদিন ভিখুর পাঁচ ছ’আনা রোজগার হয়, কিন্তু সাধারণত তাহার উপার্জন আট আনার কাছাকাছি থাকে। সপ্তাহে এখানে দুদিন হাট বসে। হাটবারে উপার্জন তাহার পুরা একটি টাকার নীচে নামে না।

এখন বর্ষাকাল অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। নদীর দুতীর কাশে সাদা হইয়া উঠিয়াছে। নদীর কাছেই বিন্নু মাঝির বাড়ীর পাশে ভাঙা চালাটা ভিখু মাসিক আট আনায় ভাড়া করিয়াছে। রাত্রে সে ওইখানে শুইয়া থাকে। ম্যালেরিয়ায় মৃত এক ব্যক্তির জীর্ণ কিন্তু পুরু একটি প্রাগৈতিহাসিক ছোটগল্প কাঁথা সে সংগ্রহ করিয়াছে, লোকের বাড়ীর খড়ের গাদা হইতে চুরি করিয়া আনা খড় বিছাইয়া তাহার উপর কাঁথাটি পাতিয়া সে আরাম করিয়া ঘুমায়।

মাঝে মাঝে শহরের ভিতরে গৃহস্থ বাড়ীতে ভিক্ষা করিতে গিয়া সে কয়েকখানা ছেঁড়া কাপড় পাইয়াছে। তাই পুঁটলি করিয়া বালিসের মত ব্যবহার করে। রাত্রে নদীর জলো বাতাসে শীত করিতে থাকিলে পুঁটলি খুলিয়া একটি কাপড় গায়ে জড়াইয়া লয়।

বস্তুসংক্ষেপ

সমস্ত বর্ষকালটাই ভিখুর ভয়ানক কষ্টে কেটেছে। আষাঢ় মাসের শুরুতেই বসন্তপুরের বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করতে গিয়ে দলের এগার জন সদস্যের মধ্যে সে ছাড়া বাকি সকলেই ধরা পড়ে। বৈকুণ্ঠ সাহার মেজ ভাইটার গলা দায়ের এক কোপে দুফাঁক করে দিলেও কাঁধে বর্শার মারাত্মক খোঁচা খেয়েও ভিখুই একমাত্র পালাতে পেয়েছিল।

রাতারাতি, দশ মাইল হেঁটে কাদা-জলে আত্মগোপন করে অবশেষে আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভিখু উপস্থিত হয়েছিল চিতলপুরে পেহ্লাদ বাগ্দীর বাড়িতে। পেহ্লাদ ভিখুকে আহত অবস্থায় আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। খুনের আসামীকে আশ্রয় দিয়ে বিপদ ডেকে আনার আশঙ্কা ছিল তার। ফলে বাধ্য হয়েই মাইল পাঁচেক দূরের বনে আশ্রয় নেয় ভিখু। পেহ্লাদই বনের সিনজুরি গাছের নিবিড় ঝোপের মধ্যে মাচা বেঁধে দিয়ে ভিখুর থাকার ব্যবস্থা করে দেয়।

ভিখুর জন্য দুদিনের খাবারও রেখে যায় সে। দুদিন পরে পুনরায় খাবার নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতিও দিয়ে যায় পেহ্লাদ। কিন্তু রাতেই ভিখুর জ্বর আসল, ফুলে-ফেঁপে ঢোল হয়ে উঠল হাত। বৃষ্টির ঠাণ্ডায় আর তাতানো রোদের গুমোটের মধ্যে মশা ও জোঁকের অসহনীয় উৎপাত প্রতিরোধ করে অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় দুদিন – দুরাত্রি পার করে দিল ভিখু। পেহ্লাদের আসার নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পূর্বেই ফুরিয়ে গেল তার খাবার জল। নির্দিষ্ট সময়েও এল না পেহ্লাদ।

বহুকষ্টে মাচা থেকে নেমে পার্শ্ববর্তী নালার জল এনে পিপাসা নিবৃত্ত করল ভিখু। পেহ্লাদের আনা শুঁড়ের লোভে আগত পিঁপড়ার অত্যাচার, রক্তশোষণ করার জন্য ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয়া পটলাকৃতি জোঁকের অবাধ বিচরণ আর সাপকে প্রতিহত করার জন্য সতর্ক প্রহরার মধ্যে বেঁচে রইল অবিনাশী মানুষের বংশধর ভিখু। মানুষ বলেই সে মরবে না, বাঁচবেই সে। পেহ্লাদ বাগ্দী গ্রামান্তরে কুটুম বাড়ি গিয়েছিল।

কুটুমবাড়ির বিয়ের উৎসবে তাড়ির নেশায় বেহুঁশ হয়ে বিস্তৃত হয়েছিল সে ভিখুকে। সেখান থেকে ফিরে বন্ধুর খোঁজ নিতে গিয়ে ভিখুর বীভৎস অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে পেহ্লাদ। সন্ধ্যা পর্যন্ত বনে অপেক্ষা করে সে। প্রাগৈতিহাসিক ছোটগল্প  পরে বাড়ি গিয়ে বাঁশের তৈরি ছোট মই ও বোনাই ভরতকে সঙ্গে করে ফিরে আসে। মই-এ শুইয়ে দিয়ে ভিখুকে বহন করে আনে তারা দুজন। নিজের ঘরের মাচার ওপর খড়ের বিছানা পেতে ভিখুর ঘুমানোর ব্যবস্থা করে পেহ্লাদ।

অমিত প্রাণশক্তির কারণেই সামান্য এই আশ্রয়টুকু পেয়ে ভিখু ক্রমশ মৃত্যুকে জয় করে ফেলল। তবে তার ডান হাতটি গাছের মরা ডালের মত শুকিয়ে অকর্মণ্য হয়ে পড়ল। এখন মাঝে-মধ্যে সে বাইরের লোকের অগোচরে বাঁশের মই বেয়ে মাচা থেকে নেমে আসে। একদিন পেহ্লাদের অবর্তমানে ভিখুর অস্বাভাবিক চাহনিতে শংকিত হয়ে পড়ে পেহ্লাদের বউ। দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে ভিখু তার একটি হাত চেপে ধরে।

কিন্তু দুর্বল ভিখুকে সামান্য আয়াসেই সামলে নেয় বাগ্‌দী ঘরের এই মেয়ে। পেহ্লাদ বাড়িতে ফিরলে ভিখুর কাণ্ড সবিস্তারে বর্ণনা করে দেয় সে। তাড়ির নেশায় আচ্ছন্ন পেহ্লাদ ঘটনাটি শুনে বোনাই ভরতকে নিয়ে আঘাতে আঘাতে আধমরা করে বাড়ির বাইরে ফেলে আসে ভিখুকে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে বাগ্দী পাড়ায় পেহ্লাদ বাগ্দীর ঘরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু পুলিশের টানাটানির ভয়ে ভিখুর নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারল না পেহ্লাদ ।

ঐ-রাত থেকেই শুরু হল ভিখুর আদিম অসভ্য জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়। পেহ্লাদের ঘরে আগুন দিয়ে একটি ডিঙ্গি নৌকা চুরি করে নদীর স্রোতে ভেসে গিয়েছিল সে। ভোরের দিকে মহকুমা শহরের ঘাটের সামনে পৌঁছায় ভিখু। নদীর জলেশান করে শরীর থেকে রক্তচিহ্ন ধুয়ে ফেলে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত ভিখু শহরের ভিতর প্রবেশ করে। রাস্তায় প্রথম যে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়, তার সামনেই হাত পেতে ভিক্ষা চায় সে। এভাবেই হয়ে যায় ভিখুর ভিক্ষাবৃত্তির হাতেখড়ি।

কয়েকদিনের মধ্যেই ভিক্ষু রপ্ত করে ফেলে ভিক্ষাবৃত্তির কলাকৌশল। মাঝে মধ্যে অকর্মণ্য ডানহাতটির দিকে তাকিয়ে আপসোস্ হয় তার। ভগবান যদি বাম হাতটি নিয়ে ডান হাতটি রক্ষা করতো তার। সংস্কৃত শোকে ভিক্ষায় অর্থাগম না হওয়ার কথা উলিখিত থাকলেও ভিখুর উপার্জন মন্দ হয় না। ফলে সুখে থেকে ও পেট ভরে খেয়ে অল্প দিনের মধ্যেই পূর্বের স্বাস্থ্য ফিরে পায় ভিখু।

অবরুদ্ধ কামনার উত্তেজনায় তার মেজাজ ক্রমশ উদ্ধত ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। স্বরচিত শয্যায় নির্ঘুম ছটফট করে সে। নারীসঙ্গ-হীন নিরানন্দ জীবন আর ভাল লাগে না তার। অতীতের উদ্দাম ঘটনাবহুল জীবনের জন্য মন হাহাকার করে ওঠে। বাজারের মুখেই পাঁচী নামের এক ভিখারিনী ভিক্ষা করতে বসে। শক্তবাঁধুনি-দেহ অল্পবয়সী এই মেয়ের একটা পায়ে হাঁটুর নীচ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত থকথকে তৈলাক্ত ঘা।

এই ঘায়ের জোরেই তার রোজগার ভিখুর চেয়েও বেশি। এ জন্যেই ঘা’টিকে সে বিশেষ যত্নে লালন করে, সারাতে দেয় না। ভিখুর নজর পড়ে এই পাঁচীর দিকেই। আলাপ জমায় সে পাঁচীর সঙ্গে, পরামর্শ দেয় ঘা সারিয়ে ফেলার; ঘা সারলে পাঁচীকে আর ভিক্ষা করতে হবে না, ভিখুর সঙ্গেই সে থাকতে পারবে। কিন্তু পাঁচী এতে রাজি হয় না। পরে ভিখু যদি তাকে তাড়িয়ে দেয় তখন জীবিকার অবলম্বন ঘা’টি সে কোথায় পাবে!

ভিখু প্রতিজ্ঞা করে একনিষ্ঠতার, সুখে রাখবার লোভ দেখায়। কিন্তু পাঁচীর মন এতে ভেজে না। পরে একদিন ঘা-সমেতই পাঁচীকে সঙ্গিনী হওয়ার প্রস্তাব দেয় ভিখু। কিন্তু ইতোমধ্যে দেরী হয়ে গেছে ভিখুর । পাঁচী অদূরবর্তী আর এক ভিখারী বসিরকে দেখিয়ে বলে ওর সঙ্গেই এখন তার সহবাস। বসিরও খঞ্জ ভিখারী। ভিখুর ডান হাতটির মতোই তারও এক পা হাঁটুর নীচে শুকিয়ে গেছে। ঐ শুকনো পা’কে অবলম্বন করেই বসিরের জীবিকা নির্বাহ হয়।

ভিখু আলাপের অজুহাতে পাশে বসতে চাইলে পাঁচী বাসিরের নাম করে ভিখুকে খুন করার ভয় দেখায়। ভিখু হেসে উড়িয়ে দেয় পাঁচীর কথা। এককালে ভিখু নিজেই কত মানুষকে একা ঘায়েল করে দিয়েছে। নিজে থেকেই বসিরের সঙ্গে আলাপ করে ভিখু। প্রথম সম্বোধনেই ক্ষিপ্ত বসির ভিখুর মাথা লাঠির ঘায়ে ‘ছেঁচা’ দেয়ার হুমকি দেয়। এতে ভিখুর রক্তও তপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু দুজনই বিপদজনকভাবে আক্রমণোদ্যত হওয়ায় মারামারি আর হয়ে ওঠে না।

ফিরে আসার আগে ভিখু বসিরকে নিপাত করার হুমকি দেয়। ক্রমে ভিখুর উপার্জনও কমে আসে। কোন রকমে পেট চলে তার। ভিখু ভাবে যে কোনো ভাবেই আয় বাড়াতে হবে তাকে। কিন্তু অকর্মণ্য ডান হাত নিয়ে আয় বাড়াবে কিভাবে সে? চুরি-ডাকাতি করার উপায় নেই। একেবারে খুন করে না ফেললে কারও কাছ থেকে অর্থ ছিনিয়ে নেয়াও তার পক্ষে অসম্ভব। পাঁচীকে ফেলে অন্যত্র যাওয়ার কথাও চিন্তা করতে পারে না ভিখু।

বিন্নু মাঝির সুখের সংসার ঈর্ষাতপ্ত করে তোলে তার মন। অবরুদ্ধ কামনা ও হিংস্রতায় এক এক সময় মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত পুরুষকে হত্যা করে পৃথিবীর যত খাদ্য ও যত নারী আছে একা সব দখল করতে না পারলে তার শান্তি হবেনা । অসন্তোষের মধ্যদিয়েই কিছুদিন সময় কাটে তার। একদিন গভীর রাতে ঝুলির মধ্যে সঞ্চিত মূল্যবান জিনিস ভরে এবং কোমরের কাপড়ে জমানো টাকা শক্ত করে বেঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে ভিখু।

কুড়িয়ে পাওয়া একটা লোহার শিক ঘষে ঘষে একপ্রান্ত চোখা করে রেখেছিল সে। এই ধারালো অস্ত্রটিও সে ঝুলির মধ্যে ভরে সঙ্গে নেয়। অন্ধকার রাতে ঈশ্বরের পৃথিবীতে তখন শাস্তস্তব্ধতা। জনহীন সেই মধ্যরাতে হেঁটে হেঁটে শহরের অপরপ্রান্তে অবস্থিত বসিরের ডেরায় পৌঁছায়। পূর্বেই একদিন ওদেরকে গোপনে অনুসরণ করে আস্তানাটি দেখে গিয়েছিল ভিখু। ভিখারীর কুঁড়ে, দরজার ঝাঁপটি ভিতর থেকে বন্ধ ছিল না বলে সহজেই ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় ভিখু।

অন্ধকারে হৃদপিন্ড শনাক্ত করা সম্ভব নয় বলে শান্ত মাথায় একটি মাত্র আঘাতে বসিরের তালুর মধ্যে শিকের চোখা দিকটা প্রায় তিন আঙ্গুল পরিমাণ ঢুকিয়ে দেয় ভিখু। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য একহাতে সবলে বসিরের গলাও চেপে ধরে সে। মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে পাঁচীকে চিৎকার করতে বারণ করে ভিখু। পরে বসিরের মৃত্যু সম্পর্কে নিঃসংশয় হলে পাঁচীকে আলো জ্বালাতে আদেশ করে সে।

পাঁচী আলো জ্বাললে পরম তৃপ্তির সঙ্গে নিজের কীর্তি প্রত্যক্ষ করে উলসিত হয় ভিখু। পাঁচীকেও হত্যা করার কপট ভয় দেখায় সে। ভীত পাঁচী পরবর্তী কর্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন করলে ভিখু বসিরের সঞ্চিত অর্থের হদিস জানতে চায়। বসিরের গোপন সঞ্চয়ের স্থানটি অনেক কষ্টে আবিষ্কার করেছিল পাঁচী। ভিখুর সামনে প্রথমে এ-বিষয়ে অজ্ঞতার ভান করলে ভিখু পাঁচীর চুলের মুঠি চেপে ধরে। অগত্যা ভীত পাঁচী দেখিয়ে দেয় বসিরের সঞ্চিত অর্থ রাখার স্থানটি।

টাকায় আধুলিতে বসিরের শতাধিক টাকার সঞ্চয় অধিকার করে খুশি হয় ভিখু। পরে পাঁচীকে পুটলি বেঁধে রাতের মধ্যেই যাত্রা করার কথা বলে। কিছুক্ষণ পরেই নবমীর চাঁদ উঠবে আকাশে, আলোয় আলোয় পথটুক পার হতে হবে। পাঁচী পুটলি বেঁধে নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে রাস্তায় গিয়ে ওঠে। পায়ের ঘা নিয়ে তাড়াতাড়ি চলতে কষ্ট হচ্ছিল পাঁচীর। ভিখু সহসা দাঁড়িয়ে পড়ে পাঁচীর পায়ের ব্যথা হচ্ছে কি না জিজ্ঞেস করে। পাঁচী তার কষ্টের কথা জানায়।

ভিখু তাকে পিঠে চাপাবে কিনা জিজ্ঞেস করলে পাঁচী ভিখুর শক্তি সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করে। ভিখু তার শারীরিক সামর্থ্যের কথা জানিয়ে পাঁচীকে তার পিঠে সওয়ার হতে আহ্বান করে। ভিখুর গলা জড়িয়ে ধরে পাঁচী তার পিঠের ওপর ঝুলে রয়। তার দেহের ভারে সামনে ঝুকে ভিখু জোরে জোরে পথ চলে। দূর গ্রামের গাছপালার পেছনে থেকে নবমীর চাঁদ উঠেছে আকাশে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে শান্ত স্তব্ধতা।

ঐ চাঁদ আর এই পৃথিবীর হয়তো ইতিহাস আছে। কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ থেকে সংগ্রহ করে দেহের অভ্যন্তরে লুকিয়ে ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে এসেছিল, সেই প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারই তারা নিজেদের সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রেখে যাবে। পৃথিবীর আলো ঐ প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারের নাগাল আজও পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে না ।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের উত্তর লিখুন:

১. ভিখুর অতীতের জীবন কেমন ছিল?

২. ভিক্ষাজীবী হিসেবে ভিখুর আত্মপ্রকাশের হেতু কী?

৩. ভিখুর ভিক্ষুক-জীবনের পরিচয় দিন। ৪. স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের পর ভিখুর মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছিল?

৫. পাঁচীর প্রতি ভিখুর আকর্ষণের কারণ কী?

৬. উপার্জন কমে আসলে ভিখুর মানসিক অবস্থার পরিচয় দিন।

৭. বসির-হত্যাকান্ড সংঘটনে ভিখুর পৈশাচিক আচরণের বর্ণনা দিন।

 

প্রাগৈতিহাসিক ছোটগল্প

 

১নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-

উত্তর : গল্পে বিধৃত ভিখুর সমগ্র জীবনই ঘটনাবহুল। হিংস্রতা ও পৈশাচিক উন্মাদনায় ভিখুর অতীত জীবন যে পূর্ণ ছিল গল্পে তার পরিচয় ভিখুর ভাবনাসূত্র থেকে পাওয়া যায়। বর্ষারম্ভে বসন্তপুরে ডাকাতি করতে গিয়ে বৈকুণ্ঠসাহার মেজো ভাইয়ের গলা দা’য়ের এক কোপে দুফাঁক করে দেয়ার পর থেকেই মূলত ভিখুকে পলাতক জীবন বা অজ্ঞাতবাস বেছে নিতে হয়। এ- সময় থেকে বসির হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত কাল অকর্মণ্য হাত নিয়ে অতীত উদ্দাম জীবনের স্মৃতিচারণ ছাড়া উপায় ছিল না ভিক্ষাজীবী ভিখুর ।

ঐ-পর্যায়ে ভিখুর ভাবনাসূত্র থেকেই জানা যায় যে, ভাঁড়ে ভাঁড়ে তাড়ি গলাধকরণ করে উন্মত্ত রাত্রিযাপনে অভ্যস্থ ছিল সে। মাঝে মাঝে দল বেঁধে গৃহস্থবাড়িতে চড়াও হয়ে লোকজনকে হত্যা এবং টাকা ও গহনা লুণ্ঠন করে রাতাতাড়ি উধাও হয়ে যেত ভিখু। স্ত্রীর সামনে স্বামীকে হত্যা করে অবর্ণনীয় পুলক অনুভব করতো সে।

পুত্রের শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরার সময়ে মায়ের সকাতর আর্তনাদের দৃশ্য প্রজ্জ্বলিত মশালের আলোয় উন্মাদনাকর নেশা ধরিয়ে দিতো ভিখুর চিত্তে। পুলিশের ভয়ে বনে জঙ্গলের পলাতক জীবনেও ছিলো ভিখুর অপরিসীম রোমাঞ্চ ও আনন্দ। দলের অনেকেই বিভিন্ন মেয়াদে একাধিক বার জেল খেটেছে, কিন্তু ভিখুকে একবারের বেশি পুলিশ ধরতে পারেনি। একবার এক নারী- অপহরণের মামলায় সাত বছরের জেল হয়েছিল তার।

কিন্তু দুবছরের বেশি জেল খাটতে হয়নি ভিখুকে; এক বর্ষার সন্ধ্যায় জেলখানার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল সে। এরপর জেল-পলাতক ফেরারী জীবনে ভিখু একা বহু গৃহস্থবাড়িতে বেড়া কেটে চুরি করেছে, দিনে দুপুরে পুকুরঘাটে একাকিনী গৃহস্থবধূর মুখ চেপে ধরে গলার হার, হাতের বালা ছিনতাই করেছে, পরস্ত্রী অপহরণ করে কাটিয়েছে প্রবাসজীবন; আবার প্রবাস থেকে একাকী প্রত্যাবর্তন করে তিনবার তিনটি দল গঠন করে গ্রামে-গ্রামে ডাকাতি করে বেড়িয়েছে পৈশাচিক উন্মাদনায়।

৪ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-

উত্তর: ভিক্ষুক-জীবনে প্রবেশ করে ভিক্ষাবৃত্তির কলাকৌশল আয়ত্ত করে ফেলার কারণে ক্ষুধার অন্নের অভাব হয়নি ভিখুর । ফলে দুবেলা পেটভরে খেয়ে ফিরে পেল সে তার লুপ্ত স্বাস্থ্য। পূর্বের মতই তার বুকের ছাতি ফুলে উঠল, অঙ্গ-সঞ্চালন মাত্র তার হাতের ও পিঠের মাংস-পেশী নেচে উঠতে শুরু করল। ক্ষুধার কষ্ট নিবৃত্ত হওয়া মাত্রই জেগে উঠল তার মনের ক্ষুধা। অবরুদ্ধ ও অবদমিত শক্তির উত্তেজনায় ক্রমে ক্রমে তার মেজাজ উদ্ধত ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়ল।

অভ্যন্ত বুলি আওড়িয়ে সকরুণভাবেই সে ভিক্ষা প্রার্থনা করে, কিন্তু প্রত্যাশাবঞ্চিত হলেই ক্রোধের সীমা থাকে না তার। জনবিরল পথে কোন পথচারী তাকে উপেক্ষা করে চলে গেলে, পথিককে গালি দিতে পর্যন্ত ভয় পায় না ভিখু। এক পয়সার জিনিস কিনে দোকানীর কাছ থেকে অযৌক্তিক ফাউ প্রত্যাশা করে মারমুখী হয়ে ওঠে সে।

ভিক্ষা প্রার্থনার ছলে নদীর ঘাটেনানরত মেয়েদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আনন্দ পায় ভিখু স্নানার্থিনীরা ভয় পেলে দুর্বিনীতি অসভ্যের মত পুলকানন্দে দাঁত বের করে হাসে, নড়ে না।

আরও দেখুন :

 

Leave a Comment