কৃতিসাধক তত্ত্ব

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-কৃতিসাধক তত্ত্ব

কৃতিসাধক তত্ত্ব

জে. এল. অস্টিন (১৯৬১ ১৯৬২) সত্যশর্তমূলক তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা প্রদর্শন করে এর বিকল্প হিসাবে তার কৃতিসাধক তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে ভাষায় এমন অনেক বাক্য আছে যেগুলো সাধারণভাবে সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়। যেমন :

আমি তোমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করছি। আমি শিশুটির নাম রাখলাম দুখু ।
এধরনের বাক্যের ব্যাপারে সত্যতা মিখাতের প্রশ্ন আসে না, যেমনভাবে আসে নীচের বাক্যগুলোতে : সে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছে। শিশুটির নাম দুখু ।

অস্টিন প্রথম শ্রেণীর বাক্যকে বলেন কৃতিসাধক, যা ব্যবহৃত হয় কোন কিছু করার জন্য। তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর বাক্যকে বলেন বাকসাধক, যা ব্যবহৃত হয় কোনকিছু বলার জন্য। কাজেই বলা মানে শুধু বলা নয়, বলা মানে করাও। যখন কেউ বলে আমি শপথ করছি যে… অথবা আমি এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে তখন সে সত্যিকার অর্থে কিছু করে।

এই করা কথার মাধ্যমে করা। অন্যদিকে বাকসাধক কোন ঘটনার বিবৃত্তিমাত্র তা দিয়ে কোন ঘটনা বর্ণনা করা হয়। কৃতিসাধক ও বাকসাধকের পার্থক্য বোঝার জন্য আমরা কিছু ইংরেজী বাকা বিবেচনা করতে পারি (Vendler 1972 129)

1. a. I suggest that Joe committed the crime.
b. Joe committed the crime.

2. a. I deny having seen the victim.
b. I have seen the victim.

3. a. I call it murder.
b. It is murder.

4. a. I urge you to proceed.
b. You proceeded.

5. a. I appoint you to the presidency.
b. You are the president.

6. a. I promise to pay on time.
b. Ipaid on time.

7. a. I apologize for having offended you.
b. I have offended you

উপরের বাক্যজোড়সমূহের প্রথমটি কৃতিসাধক এবং দ্বিতীয়টি বাকসাধক। কোন বাক্যকে কৃতিসাধক হওয়ার জন্য বিশেষ পরিস্থিতির প্রয়োজন। যেমন আমি তোমাদের দুজনকে স্বামী-স্ত্রী বলে ঘোষণা করছি। এ বাক্যটি যে কেউ বললে বা যেখানে সেখানে বললে এটি বৈবাহিক সম্পর্কের ঘোষণা হবে না।

 

কৃতিসাধক তত্ত্ব

 

এটি উচ্চারিত হতে হবে কোন আইনসম্মত বা ধর্মীনির্ধারিত ব্যক্তি দ্বারা বিশেষ দুজন নর-নারীর সামনে স্বাক্ষীসমেত কোন আসরে । আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি আমার ছোটভাইকে দিয়ে গেলাম, আমি এই অভিযানের নাম দিলাম মরুঝড় ইত্যাদির ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।

অর্থাৎ কৃতিসাধককে সফল হতে হলে কতগুলো শর্ত পূরণ করতে হয় । শর্ত পূরণ না করতে পারলে তা ব্যর্থ হয়ে। অস্টিন কৃতিসাধকের চারটি শর্তের কথা উল্লেখ করেন :

১. একটি প্রথাগত প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব থাকবে যেখানে একটি পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যক্তির দ্বারা বিশেষ শব্দগুচ্ছ উচ্চারিত হলে একটি বিশেষ প্রথাগত ফলাফল সৃষ্টি করবে ।

২. প্রথাগত প্রক্রিয়াটি সম্পাদানের জন্য বিশেষ ব্যক্তি এবং পরিস্থিতি যথোপযুক্ত হবে ।

৩.এ অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিগণ কর্তৃক প্রক্রিয়াটি সঠিরভাবে বাস্তবায়িত হবে ।

৪. অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিগণ কর্তৃক প্রক্রিয়াটি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হবে ।

প্রথাগত কথামূলক কাজের জন্য এই চারটি শর্ত প্রতিপালিত হতে হবে । ভালোভাবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখবো যে এর জন্য কিছু প্রথাগত শব্দও নির্দিষ্ট করা থাকে। বিবাহের ক্ষেত্রে আইনী কাজে এ ধরনের শব্দের প্রয়োগ স্পষ্ট। মুসলমানী বিবাহে কাজীর জবাবে বর কনে কবুল শব্দ উচ্চারণ না করলে বিবাহ হয় না।

বিশেষ পারিবারিক অবস্থায় তালাক শব্দটি তিনবার উচ্চারণ করলে বিবাহ ভঙ্গ হয়। দলিলাদির ক্ষেত্রে আমি প্রত্যয়ন করছি যে……. আমি এতদ্বারা ঘোষণা করছি যে….. এই জাতীয় শব্দের প্রয়োগ আছে। এখানে আরেকটি জিনিস লক্ষ্যণীয় যে কৃতিসাধনমূলক বাক্যে কর্তা হিসাবে প্রথম পুরুষ একবচন এবং ক্রিয়ার সাধারণ কাল কর্মবাচ্য রূপ ব্যবহৃত হয় । ইংরেজীতে হয় 1 + present action simple verb (Coulthard 1985: 16) : আমরা লক্ষ্য করতে পারি :

I thank you.

I bid you welcome.

তবে সব কৃতিসাধকেরই যে এরকম বাক্যতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। যেমন যাত্রীদের সীটবেল্ট বেঁধে নিতে অনুরোধ করা হচ্ছে, তাকে এখান থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য আদেশ দেয়া হচ্ছে, সবাইকে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে কেউ যাতে নকল না করে এ ধরনের বাক্যও কৃতিসাধক।

 

কৃতিসাধক তত্ত্ব

 

পার্থক্য করার জন্য প্রথম শ্রেণীর বাক্যকে বলা যেতে পারে প্রকাশ্য কৃতিসাধক এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর বাক্যকে বলা যেতে পারে অপ্রকাশ্য কৃতিসাধক। প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য যে কোন কৃতিসাধকই শর্তের উপর নির্ভরশীল। উপরে আমরা চারটি সাধারণ শর্ত উল্লেখ করেছি। কোন বিশেষ কৃতিসাধকের জন্য আবার বিশেষ নিয়মগুচ্ছের প্রয়োজন। এধরনের নিয়মগুচ্ছকে অস্টিন বলেন সুৰ-শর্ত। অর্থাৎ এ বিশেষ শর্তগুলো প্রতিপালিত হলে একটি বিশেষ কৃতিসাধক

সুখী বা সফল হয় এবং সেগুলো প্রতিপালিত না হলে তা অসুখী বা ব্যর্থ হয়। যেমন প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সুশর্ত ক্রিয়া (Levinson 1983 : 238-239)

১. বক্তা বলে যে সে একটি ভবিষ্যৎ কর্ম সম্পাদন করবে।

২. সেটি করার ইচ্ছা তার আছে।

৩. সে বিশ্বাস করে যে সে তা করতে পারে।

৪. সে মনে করে যে সাধারণ ঘটনাপ্রবাহে সে সেটি করতো না।

৫. সে মনে করে যে এটি করুক শ্রোতা তা চায় ।

৬. প্রতিশ্রুতিমূলক বাক্যটি উচ্চারণ করে সে নিজেকে একটি বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে যায় ।

৭. বক্তা ও শ্রোতা উভয়েই প্ৰতিশ্ৰুতিমূলক বাক্যটি বুঝতে পারে ।

৮. তারা উভয়েই সচেতন স্বাভাবিক মানবীয় প্রাণী ।

৯. অন্যান্য শর্ত প্রতিপালিত হলে বাক্যনিহিত বিশেষ (কৃতিসাধক) শক্তি ক্রিয়াশীল হয়।

এগুলো প্রতিপালিত হলেই বলা যাবে কারো আমি প্রতিশ্রুতি করছি…….. এ জাতীয় কৃতিসাধক সুখী বা সফল হয়েছে । অন্যথায় বলতে হবে তা অসুখী বা ব্যার্থ হয়েছে ।
আমরা লক্ষ্য করে থাকবো কৃতিসাধনমূলক বাক্যে বিশেষ ধরনের ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। সব ধরনের ক্রিয়া
কৃতিসাধকের উপযোগী নয়। যেমন :

আমি তোমাকে পিটাচ্ছি । আমি প্রতিদিন সকালে পৌড়াই ।

পিটানো, দৌড়ানো ইত্যাদি ক্রিয়া কৃতিসাধনমূলক নয়। কারণ আমি তোমাকে পিটাচ্ছি এ কথা বললেই কাউকে পিটানো হয়ে যায় না কিংবা আমি প্রতিদিন সকালে দৌড়াই একথা বললেই দৌঁড়ানো হয়ে যায় না। কিন্তু আমি বাজি ধরছি, আমি প্রতিজ্ঞা করছি এ ধরনের বাকা বললে ঠিকই বাজি বা প্রতিজ্ঞা হয়ে যায়। যে ধরনের ক্রিয়া কৃতিসাধনমূলক বাক্যে ব্যবহ্যত হয় তাদের বলে কৃতিসাধক ক্রিয়া ।

অস্টিন কৃতিসাধক ক্রিয়াগুলোকে পাঁচটি উপশ্রেণীতে বিভক্ত করেন, যথা :

১. রায়সাত্মক এ ধরনের ক্রিয়াগুলো জুরি, বিচারক বা আম্পায়ারের রায় ঘোষণার মতো, যেমন খালাস – দেয়া, গ্রেড দেয়া, পরিমাপ করা, সনাক্ত করা।

২. ক্ষমতাসাধক এ ধরনের ক্রিয়াগুলো ক্ষমতা, অধিকার বা প্রভাব খাটানোর সাথে সম্পর্কিত, যেমন – নিয়োগ করা, আদেশ করা, উপদেশ দেয়া, সতর্ক করা।

৩. অঙ্গীকারসাধক এ ধরনের বাক্যগুলো বক্তার তরফ থেকে কোন অঙ্গীকার বা অন্য কোন ধরনের ঘোষণার ইঙ্গিত দেয়, যেমন – প্রতিশ্রুতি করা, গ্যারান্টি দেয়া, বাজি ধরা, বিরোধিতা করা।

৪. আচারসাধক এ ধরনের ক্রিয়াগুলো বিভিন্ন ধরনের মনোভাব ও সামাজিক আচরনের সাথে যুক্ত, যেমন –
ক্ষমা চাওয়া, সমালোচনা করা, আশীর্বাদ দেয়া, চ্যালেঞ্জ করা।

৫. চিন্তাসাধক এ ধরনের ক্রিয়াগুলো দেখায় কিভাবে একটি সম্পর্কে উক্তি বা উক্তিসমূহ খাপ খায় বা ব্যবহৃত হয়, যেমন যুক্তি দেখানো, বিধিবদ্ধ করে দেয়া, নিশ্চিত করা, একমত হওয়া। –

অস্টিনের কাছে, কোন কিছু বলা মানেই কোন কিছু করা (to say something is to do something)। তিনি বলেন যে বক্তার কোন উক্তি একসাথে তিন ধরনের অর্থ প্রকাশ করতে পারে অথবা তিন ধরনের কর্ম সম্পাদন করতে পারে। এগুলো হলো :

ক. বামূলক কর্ম : বামূলক কর্ম হলো কোন উক্তির শাব্দিক বা আক্ষরিক অর্থ। যেমন কেউ যদি বলে ওখানে সাপ আছে, তখন শ্রোতা এর এই আক্ষরিক অর্থ আবিস্কার করি যে কোন একটি বিশেষ জায়গায় একটি বিশেষ ধরনের সরীসৃপ আছে ।

খ. অবান্তমূলক কৰ্ম : অবামূলক কর্ম বলতে বোঝায় আক্ষরিক অর্থের বাইরে বক্তার মনের কোন গুড় ভাব, যেমন কোন কৃতিসাধক। ওখানে সাপ আছে একথা বলে বক্তা বোঝাতে পারে যে সাবধান হও অথবা ওটাকে হত্যা করো। এ ধরনের অর্থ শ্রোতা উক্তির আক্ষরিক অর্থ থেকে উদ্ধার করেনা, উদ্ধার করে বক্তার মন পাঠের মাধ্যমে অথবা পরিস্থিতি থেকে ।

গ. পরিবামূলক কর্ম পরিবাত্তমূলক কর্ম বলতে বোঝায় শ্রোতার মনের উপর উক্তির যে ফলাফল তাকে । যেমন ওখানে সাপ আছে এই কথাটি বললে বক্তার মনে ভয়ের উদয় হতে পারে, ফলে সে লাফিয়ে উঠবে অথবা দৌড়ে পালাবে কিংবা তার মনে আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া হতে পারে যার ফলে সে হয়তো সাপটিকে লাঠি দিয়ে আঘাত করবে। বক্তার মনের উপর এই ধরনের প্রভাবও উক্তির অর্থের অন্তর্ভুক্ত ।

 

কৃতিসাধক তত্ত্ব

 

এভাবেই অস্টিন তার কৃতিসাধক তত্ত্বের মাধ্যমে অর্থের বিভিন্ন দিক উম্মোচিত করেন, যে অর্থ আসে ভাষার বাস্তব ব্যবহার থেকে। তিনি ভাষাকে দার্শনিকের টেবিল থেকে নামিয়ে আনেন জনস্রোতে হাটেমাঠে মাঠে যেখানে সাধারণ মানুষ প্রথাগত বা সামাজিক নিয়মে ভাষা ব্যবহার করে। এজন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসার পাবিদার। তার প্রশংসায় মান্ডল (১৯৭১ : ৮২-৮৩) বলেন :

“অস্টিন ভাষাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, ব্যাকরণে এক নূতন মাত্রা যোগ করেছেন ব্যাকরণের চেয়ে অধিক ভারিক্কিমার্কা কিছু না দিয়েও । অস্টিনের লেখা মৌলিকত্ব, সূক্ষ্ণতা ও বিচক্ষনতায় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।”

আরও দেখুন:

Leave a Comment