শব্দার্থ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-শব্দার্থ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া

শব্দার্থ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া

নামের সাথে যুক্ত থাকে অর্থ অথবা অর্থের সাথে যুক্ত থাকে নাম নাম ও অর্থের এই পারস্পরিক সম্পর্কের ফলেই শব্দার্থের উদ্ভব হয়। আর যখনই কোন অর্থের সাথে নতুন নাম প্রযুক্ত হয় এবং/অথবা কোন নামের সাথে নতুন অর্থ প্রযুক্ত হয় তখনই শব্দার্থের পরিবর্তন ঘটে।

শব্দার্থ পরিবর্তনের এই সাধারণ সূত্রটি এবার ব্যাখ্যা করা যাক। সূত্রমতে কোন অর্থের সাথে নতুন নাম যুক্ত হতে পারে এবং কোন নামের সাথে নতুন অর্থ যুক্ত হতে পারে। অর্থ ও নামের এই মিথক্রিয়ার ফলে দুটি অবস্থার উদ্ভব হতে পারে :

(১) একটি অর্থ দুটি নাম এবং
(২) একটি নাম দুটি অর্থ।

প্রথম অবস্থাকে বলে সমনামিতা এবং দ্বিতীয় অবস্থাকে বলে অনেকার্থকতা। দুটি অবস্থাকে নিম্নরূপ লেখচিত্রে কোশ করা যায় :

 

শব্দার্থ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া

 

প্রথম অবস্থা অর্থাৎ সমনামিতাকে উদাহরণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন মানুষ যে প্রভাগ দিয়ো কাজ করে তার জন্য সংস্কৃত শব্দ ছিলো হত পরে প্রাকৃত ভাষা থেকে নতুন শব্দ আসলো হাত। ফলে একই জিনিস বোঝাতে দুটি নাম ব্যবহৃত হতে থাকলো।

দ্বিতীয় অবস্থা অর্থাৎ অনেকার্থকতার উদাহরণ দেখা যায় এভাবে – প্রথমে পরত শব্দটি কেবল আগামী দিনের পরের দিনকে বোঝাতো, কিন্তু কালক্রমে এটি গতদিনের পূর্বের দিনকেও বোঝাতে শুরু করে। উদাহরণের শব্দগুলোকে চিত্রে স্থাপন করলে দেখাবে এর

 

শব্দার্থ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া

 

এখানে অনেকার্থকতার ক্ষেত্রে আমরা জানি না পরত নামের সাথে যুক্ত হওয়ার আগে গতদিনের পূর্বের দিন এই অর্থের কোন নাম ছিল কি না। হয়তো নামের অভাবই অর্থটিকে পরত শব্দের দিকে চালিত করেছে। সিফেন উলম্যান (১৯৫৭ ২২০) শব্দার্থের পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিম্নলিখিত তালিকা পেশ করেন :

ক. ভাষিক রক্ষনশীলতার দরুন শাব্দার্থিক পরিবর্তন
.খ ভাষিক উদ্ভাবনার দরুন শব্দার্থিক পরিবর্তন
১.এ নামের স্থানান্তর
অ অর্থের সাথে অর্থের সাযুজ্যের মাধ্যমে আ অর্থের সাথে অর্থের সামীপ্যের মাধ্যমে

২. অর্থের স্থানান্তর:
এ নামের সাথে নামের সাম্রজ্যের মাধ্যমে
আ নামের সাথে নামের সামীপ্যের মধ্যমে

যৌগিক পরিবর্তন

উয়াম্যান নাম ও অর্থের যে স্থানান্তরের কথা বলেছেন তাকে একটি মাটিক্সের মাধ্যমে দেখানো যায়

 

শব্দার্থ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া

 

জাহাঙ্গীর তারেকের মতে, উপম্যানের এই শ্রেণীকরণ সংকেতমান প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিশেষ গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভূক্ত করে একদিকে সংকেতক (নাম) সংকেতিত (অর্থ) এর ডিসেতু এবং অন্যদিকে প্রক্রিয়াটির মনো- অনুষঙ্গাত্মক প্রকৃতি, অনুষঙ্গর মানচিত্রের সাযুজ্য বা সামীপ্য যার দ্বৈতরূপ এতে সম্পইভাবে ধরা পড়ে। টুপি শব্দটির দ্বারা ব্যাপরাটিকে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন:

এক. পাগড়ি হাটে আমামা শিরস্ত্রাণ ইত্যাদি আমরা পাই অর্থের সাযুজ্যের মাধ্যমে ১. মধ্য পঞ্চাবি পাজামা ইত্যাদি আমরা পাই অর্থের সামীপ্যের মাধ্যমে ২০. চুপি চুপি কুপি কপি ইত্যাদি আমরা পাই নামের সানুজ্যের মাধ্যমে। ২খ, কিশতি চুড়ি খেলো টুপি ইত্যাদিতে কিশতি ভাল পাই নামের সামপোর মাধ্যমে ।

উলমান তার শ্রেণীকরণে ভাধিক রক্ষণশীলতার কথা বলেছেন। ভাষা সাধারণত তার নিজের শব্দাবলীকে ধরে রাখতে চায়। অনেক সময় শব্দটির রূপের পরিবর্তন হয় কিংবা শব্দের (অর্থাৎ নামের উপর নতুন অর্থ প্রযুক্ত হয়, কিন্তু শব্দটি থেকে যায় ভাষার ভান্ডারে।

যেমন, ঘড়ি (২টি) বলতে ঘটির মধ্যে জল বা বালু দিয়ে নির্মিত সময় হিসাব করার যন্ত্রকে বোঝাতো। আজ ঘড়ির আকার আকৃতি উপাদান সবই পরিবর্তিত হয়েছে – আজ একে আমরা কব্জিতে বাঁধি, দেয়ালে ঝুলাই, তথাপি এর জন্য আমরা অন্য শব্দ ব্যবহার করি না, গতানুগতিকভাবে ঘড়িই ব্যবহার করি ।
অর্থের সাথে অর্থের সাযুজ্যের মহামে নামের স্থানান্তর ঘটতে দেখা যায় প্রায়শই। অর্থের সাবুজা তিন ধরনের হতে পারে

ক) সারাত্মক দুটি জিনিসের মধ্যে মূলগত সাদৃশ্য। যেমন গাছের পাতা ও কাগজের পাতার মধ্যে রূপ, বৃত্তি ও অবস্থানগত মিল । প্রাকৃতিক ঋতু সময়কে ঘুরে ঘুরে আসে, নারীর যৌবনিক ঋতুও তেমনি সময়চক্রে আবর্তিত হয়। তাই কি কবি নারীকে ঋতুর সাথে তুলনা করেন ?
আমাদের জন্য উৎসব নিয়ে আসে সাতটি ঋতু গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত এবং নারী।

(খ) সাংচেতনিক : এক ইন্ডিয়ের সংবেদনকে অন্য ইন্দ্রিয়ের সংবেদনের সঙ্গে এক করে দেখা। যেমন রঙের সঙ্গে ভূমি, গঞ্জের সঙ্গে রাষ্ট্র গুলির সঙ্গে গন্ধ এর সমতলে চলে আসতে পারে। অনেক সময় বলা হয় সুন্দর গন্ধ – গন্ধ কি চোখে দেখা যায় যে তার সৌন্দর্য বর্ণনা করা যাবে ? শব্দ ভবনেন্দ্রিয়ের জিনিস, কি মাণেন্দ্রিয়ে ক্রিয়া করে তবে তা হবে সাংচেতনিক। যেমন, সুকুমার রায়ের হুড়ায় আমরা পাই :
রামছাগলের ভারী গলায় ভ্যা ভ্যা রবের তাকে সুড়সুড়ি দেয় থেকে থেকে চৌকিদারের নাকে।

(গ) আনুভূতিক : কোন অনুভূতিকে একটি মূর্ত বস্তুর সঙ্গে সমীভূত করে বাটির গুণাবলী অনুভূতিটির উপর আরোপ করা, যেমন উষ্ণ অভিনন্দন, মধুর ভাষণ বর্ণাঢ্য জীবন ইত্যাদি । মূর্ত জিনিসের ওজন হয় ি যদি বিমূর্ত জিনিসের ওজনের কথা বলা হয় তা হবে আনুভূতিক অর্থে। যেমন আমরা পাই তিন মণ ওজনের

কাকের নেয় মজুমদার
সে ঝাড় সুবিখ্যাত পুমদার কালু সিং দেয় তারে পাকা তিন মণ ওজনের থাকা।
বিদেশী শব্দের সাদৃশ্যে বাংলা ভাষায় বেশ কিছু নতুন শব্দ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ইংরেজী bougainvillea শব্দের অনুকরণে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ফুলের নামকরণ করেছিলেন বাগান বিলাস। বিদ্যাসাগর university – সাদৃশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শব্দ গঠন করেন।

সুধীন্দ্রনাথ ইউরোপের ক্লাসিক্যাল মিউজিকের সঙ্গে এদেশের গ্রুপদ অঙ্গের গানের একটি সারপা নির্ণয় করে classical অর্থে ধ্রুপদী শব্দটি চালু করেন। এখন আমরা গ্রুপদী নাচ, ধ্রুপদী সাহিত্য প্রভৃতির কথা বলে থাকি। বাংলা আমার শব্দটি যে পর্তুগীজ আনান শব্দ থেকে সাদৃশ্যকরণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তা পণ্ডিত সমাজে সুবিদিত ।

অর্থের সাথে অর্থের সামীপ্যের মাধ্যমে নামের জানান্তর ঘটতে পারে। দুটি অর্থের সামীপ্য মুনিক, কালিক অথবা কারণিক হতে পারে :

(ক) স্থানিক লাম ( ) নামক নৌকায় পরিবাহিত হতো বলে বাংলায় এক ধরনের চালের নাম হয়েছে বালাম । সিন্ধু (আরবী উচ্চারণ হিন্দু) নদীর তীরে বসবাস করতো বলে ঐতিহাসিকভাবে ভারতবাসীদের নাম হয়েছিল হিন্দু (পরে হিন্দু হয়েছে বিশেষ সনাতন ধর্মাবলম্বী জাতি)।

খ) কালিক : আরবী রমজান মাসে পালিত হয় বলে অনেকে সিয়াম বা রোজাকে রমজান বলে থাকেন ( পার্বন অর্থো, যেমন রমজানের তাৎপর্য্য)। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় বলে হিন্দুদের বিশেষ পূজা অনুষ্ঠানের নাম আহ্নিক।

(গ) কারণিক মাথার চুলকে চিত্রে বলে বিশেষ কেন বিন্যাসকারী পদার্থের নাম হয়েছে চিরুনী। কম্পিউট বা হিসাব করে বলে বিশেষ যন্ত্রের নাম হয়েছে কম্পিউটার ।

নামের সাথে নামের সাযুজ্যের মাধ্যমে অর্থের স্থানান্তর ঘটতে পারে। যেমন আরবী মুগ্ধা (উদ্দেশ্য বা অর্থ) শব্দের সঙ্গে কথা যোগ করে সোজা কথা গঠিত হয়েছে যা উচ্চারণ সাদৃশ্যে পরিণত হয়েছে মোটা কথা এবং পরে মোট করা। আবার নামের সাথে নামের সামীপ্যের মাধ্যমেও অর্থের স্থানান্তর ঘট।

মর্তমান শব্দের সাথে কলা শব্দটি এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে শুধু মর্তমান বললেই বিশেষ প্রকৃতির ফলকে বোঝায়। গায়ে হলুদ – এর জন্য শুধু হলুদ বলা যায়। দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক প্রভৃতি শব্দের সাথে এখন আর পত্রিকা শব্দটির উল্লেখের প্রয়োজন নেই।

একটি অর্থের সাথে কেবল একটি নয়, একাধিক নাম এসে যুক্ত হতে পারে। যেমন একটি অর্থের সাথে তিনটি অর্থ কিভাবে যুক্ত হয় তা উলম্যান নিম্নরূপ চিত্রের মাধ্যমে প্রদর্শন করেন :

 

শব্দার্থ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া

 

আমরা বাংলায় গ্রন্থ পুরুক, বই এই তিনটি শব্দ দিয়ে প্রক্রিয়াটির উদাহরণ দিতে পারি। শব্দগুলি চিরে বসালে তবে এরকম :

শব্দার্থের যৌগিক পরিবর্তন ঘটতে পারে নানাভাবে। যেমন, একটি অর্থের সাথে একত্রে অন্য একটি অর্থ ও নাম যুক্ত হতে পারে অথবা একটি নামের সাথে একত্রে অন্য একটি নাম ও অর্থ যুক্ত হতে পারে ইত্যাদি। একটি অর্থের সাথে অন্য একটি অর্থ ও নাম যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে উলম্যান দেখিয়েছেন এভাবে

 

শব্দার্থ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া

প্রক্রিয়াটিকে আমরা বাংলায় একটি উদাহরণের সাহায্যে স্পষ্ট করতে পারি। বাংলায় সারা শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। বিধবা শব্দের বৈপরীতে, যদিও বাংলায় বর বলে কোন শব্দ নেই। এটি হয়েছে পত্নীক, বিপত্নীক শ ঘরের সাদৃশ্যে বা প্রভাবে বা মধ্যস্থতায়। পরিস্থিতি আরো জটিল হয় যখন কাল্পনিক ধাতু ধা থেকে তৈরী হয় বৈষ্ণবা বৈধব্য প্রভৃতি শব্দ ।পরিবর্তনের ধারায় একটি নামের সাথে একত্রে অন্য একটি নাম ও অর্থের সংযুক্তি ঘটতে পারে । একটি নামের সাথে অন্য নাম ও অর্থ যুক্ত হওয়ার প্রক্রিটি উলমান দেখিয়েছেন এভাবে :

বাংলা থেকে একটি উদাহরণ দেয়া যায়। বাংলায় নয় শব্দের অর্থ উলঙ্গ। ব্যুৎপত্তির দিকে তাকলে আমরা দেখি শব্দটি এসেছে গ্রা (সম্মানিত মহিলা) থেকে না (প্রথমে অসম্মানিত, পরে বেশ্যা ও উলঙ্গ) শব্দের পর ধরে । এভাবেই দেখা যায় নাম ও অর্থ নানারূপ মিডিয়ায় অংশগ্রহণ করে ঐতিহাসিক ধারায় শব্দার্থের বহুবিচিত্র পরিবর্তন ঘটায়।

আরও দেখুন:

 

Leave a Comment