আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়-মানসচিত্র তত্ত্ব
মানসচিত্র তত্ত্ব
মানসচিত্র তত্ত্ব অনুসারে কোন শব্দ উচ্চারণ করলে মনে যে ভাব বা চিত্র ফুটে ওঠে তা-ই হলো শব্দটির অর্থ । অর্থাৎ এ তত্ত্ব অনুসারে
কেউ যদি কুকুর শব্দটি উচ্চারণ করে তাহলে মনে কুকুরের ছবি, গরু শব্দটি উচ্চারণ করলে গরুর ছবি, বিড়াল শব্দটি উচ্চারণ করলে বিড়ালের ছবি ভেসে উঠতে পারে। দার্শনিক জন লক সর্বপ্রথম এ তত্ত্বের কথা প্রচার করেন । তিনি বলেন যে ভাষার শব্দসমূহ কোন না কোন ভাবের সাথে যুক্ত এবং ঐ ভাবই হল শব্দের অর্থ ।
ভাষা ভাব আদানপ্রদানের মাধ্যম এবং সেই ভাব বাহিত হয় শব্দে বা বাক্যে। লকের কথার প্রতিধ্বনি করে সুজান ল্যাঙ্গার (১৯৫১ : ৪৯) বলেন যে আমরা যখন বন্ধু সম্পর্কে কথা বলি তখন মনের ভিতরে বন্ধ থাকে না, থাকে বছর ধারণা এবং অর্থ বলতে তাই করে ধারণা বুঝায়, সাক্ষাত বস্তু বুঝায় না। গ্লাসবার্গ ও জ্যাকস
( ১৯৭৫ : ৫০) একই কথা বলেন, “কোন শব্দের সম্ভাব্য অর্থের সেট বলতে বোঝাবে সম্ভাব্য অনুভূতি, মানসচিত্র ভাব, ধারণা, চিন্তা ও অনুমানের সেটকে যা কোন মানুষের মনে উদ্ভাসিত হয় যখন সে শব্দটি প্রবন অথবা প্রক্রিয়াজাত করে।”
এ্যালটনের (১৯৬৪ : ২৩-২৪) মতে, যোগাযোগের দৃষ্টিকোণ থেকে এই তত্ত্ব তিনটি বিষয়ের সাথে যুক্ত –
প্রথমত, কোন ভাব বক্তার মনে উপস্থিত থাকে । দ্বিতীয়ত, বক্তা সেই ভাব ভাষায় প্রকাশ করেন।
তৃতীয়ত, অর্থোদ্ধার প্রক্রিয়ায় শ্রোতার মনে সেই ভাবের পুনরুদয় হয় । সফল যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তিনটি শর্ত প্রতিপালিত হয়। অন্যথায় যোগাযোগ ব্যার্থ হয়।
যেমন অনেক ক্ষেত্রেই শ্রোতাকে এরকম কথা বলতে শোনা যায় তোমার কথাটি আমার কাছে স্পষ্ট নয় কিংবা ঠিক বুঝতে – পারলাম না তুমি কি বলতে চাচ্ছো ইত্যাদি । এর মানে হলো বক্তার মনের ভাব সফলভাবে শ্রোতার মনে সঞ্চারিত হয়নি ।
এ তত্ত্বের একটি গুণ এই যে এর মাধ্যমে কল্পিত বছর ব্যাখ্যা দেয়া যায় যা বাচ্যার্থমূলক তত্ত্বের মাধ্যমে দেয়া যায় না । যেমন ভূত, পরী বাস্তবে এদের অস্তিত্ব না থাকলেও আমরা বলতে পারি মানুষের মনে এদের ধারণা বা চিত্র থাকে যার ফলে আমরা সংশ্লিষ্ট শব্দগুলো ব্যবহার করতে পারি । মানসচিত্র তত্ত্ব ভাষার অর্থকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। । তাই এ তত্ত্ব নানাভাবে সমালোচিত
হয়েছে ।
প্রথমত, এ তত্ত্ব অর্থ কি অনুভূতি, মানসচিত্র, ভাব, ধারণা, চিন্তা না অনুমান তা সুনির্দিষ্টিভাবে বলতে পারে না । অর্থ একসাথে এগুলোর সবকিছু হতে পারে না, কারণ আমরা জানি এসব অভিন্ন সত্ত্বা নয় । দ্বিতীয়ত, এ তত্ত্ব অভিজ্ঞতামূলকভাবে যাচাইযোগ্য নয়। ধারণা, ভাব, মানসচিত্র এসব মানসিক অবস্থার কোন বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা নেই ।
তৃতীয়ত, শব্দ উচ্চারণ করলে মনে যে ছবি ভেসে ওঠে তাই শব্দটির অর্থ নয় । যেমন কেউ বিড়াল শব্দটি উচ্চারণ করলে আমাদের বাড়ীর কুচকুচে কালো হুলো বিড়ালটির ছবি আমার মনে ভেসে উঠতে পারে। তাহলে ঐ বিশেষ বিড়ালটির ছবি কি বিড়াল শব্দের অর্থ ?
চতুর্থত, মানসচিত্র যদি শব্দের অর্থ হয় তাহলে প্রশ্ন উঠবে মানসচিত্রের অর্থ কি ? তার ব্যাখ্যার অর্থ অন্য একটি মানসচিত্র দরকার হয়ে পড়বে, সেটি ব্যাখ্যার জন্য আবার আরেকটি। এভাবে অসীমভাবে চলতেই থাকবে
। ফলে এ তত্ত্ব পৌনপুনিকতা দোষে দুষ্ট।
পঞ্চমত, এবং, যদি, তবে কিন্তু, অথবা প্রভৃতি অব্যয়ের মানসচিত্র কি হবে তা বোঝা কঠিন। তাই এ তত্ত্ব সমস্ত শব্দের বেলায় প্রযোজ্য নয়। ষষ্ঠত, এ তত্ত্ব শব্দের অর্থ ব্যাখ্যায় প্রযোজ্য হলেও বাক্যের অর্থ ব্যাখ্যায় প্রযোজ্য নয়। বাক্য শব্দযোগে গঠিত হলেও বাক্যের অর্থ শব্দসমূহের অর্থের সমষ্টিমাত্র নয় ।
এজন্য শব্দের সাথে যুক্ত টুকরো টুকরো মানসচিত্র জোড়া দিয়ে কেউ যদি মানসচিত্র অনুক্রমের সাহায্যে বাক্যার্থ ব্যাখ্যা করতে চায় তবে তা হবে ভ্রমাত্মক ।
মানসচিত্রের মাধ্যমে নীচের স্তবকের শব্দ ও বাক্যের অর্থ ব্যাখ্যা করা যায় কি কিংবা ব্যাখ্যা করলে তা সবার কাছে একইরকম হবে কি ?
আমার আপনার চেয়ে আপন যে খুঁজি তারে আমি আপনায় । আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি আমারি তিয়াসী বাসনায় ।
কাজেই বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বলা যায় মানসচিত্র তত্ত্ব বাগর্থিক তত্ত্ব হিসাবে সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় । দার্শনিক কোয়াইন (১৯৬১ : ৪৮) খুব কড়া ভাষায় বলেন, “The idea of an idea, the idea of the mental counterpart of a linguistic form, is worth than worthless.””
আরও দেখুন: