যৌবনে দাও রাজটিকা

বাংলা গদ্য সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে একক ও অনন্য। শুধু গদ্যভঙ্গিই নয়, বিষয় নির্বাচনেও তিনি অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। তিনি ছিলেন মূলত যৌবন বন্দনাকারী। জড়তাগ্রস্ত স্থবির বাঙালি সমাজজীবনে প্রাণসঞ্চার ও নবজীবন প্রতিষ্ঠাই ছিলো তাঁর কাম্য।

‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী দৈহিক যৌবনের চেয়ে সামাজিক যৌবনের অধিক প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে একে রাজসম্মানে ভূষিত করতে বলেছেন। প্রবন্ধটিতে প্রমথ চৌধুরীর স্বতন্ত্র গদ্যরীতির পরিচয়ও লভ্য।

যৌবনে দাও রাজটিকা

 

যৌবনে দাও রাজটিকা ১

 

লেখক পরিচিতি

প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট পাবনা জেলার হরিপুরে জমিদার চৌধুরী বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দুর্গাদাস চৌধুরী। প্রমথ চৌধুরীর শিক্ষাজীবন বিচিত্র ধারায় অগ্রসর হয়। তিনি কলিকাতা ডেভিড হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শন বিষয়ে প্রথম শ্রৌণতে বি.এ পাশ করেন। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম শ্রেণীতে ইংরেজি বিষয়ে এম.এ পাশ করে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে আইন পড়তে যান ইংল্যান্ড।

সেখান থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে কলিকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। পরে আইন কলেজেও অধ্যাপনা করেন। বিবাহ করেন ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে; কনে ইন্দিরা দেবী। ইন্দিরা দেবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা। প্রথম চৌধুরী আইনজীবী হলেও সুকুমার সাহিত্যচর্চাকে তিনি সর্বদা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এবং নিজেও ছিলেন সে-পথের পথিক। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

কবিতা, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনায় প্রথম চৌধুরী যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ভাষায় সুষম বিন্যাস ও অলঙ্কারের যথাযথ প্রয়োগ তাঁর রচিত কবিতাকে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করে। সনেট রচয়িতা হিসেবেও তাঁর পরিচয় সমধিক। মূলত ইটালীয় সনেট রীতিকে তিনি অনুসরণ করেছেন। শব্দচয়ন, তীক্ষ্ণ, উজ্জ্বল ও চাপা ব্যঙ্গের সরসতায় তাঁর কাব্যদেহ গঠিত। ছোটগল্প রচনাতেও তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভা ও উজ্জ্বল ভাষাশিল্পের দুর্লভ সমন্বয় ঘটেছে।

তিনি কিছুটা আয়াস-সাধ্য রীতিতে গল্প উপস্থাপন করলেও সে কৃত্রিমতা স্পষ্ট না হয়ে বরং অধিক হৃদয়গ্রাহ্য হয়ে উঠেছে তাঁর কারুকার্যময়তা। তিনি যে প্রবন্ধাবলী রচনা করেন তাতে চলিত কথ্যভাষার মার্জিত প্রয়োগ দেখা যায়। প্রখর বুদ্ধিদীপ্তি, অপূর্ব বাকচাতুর্য, পরিশীলিত রুচি, বলিষ্ঠ যুক্তিপ্রবণতা এবং সুমধুর অথচ ধারালো হাস্যরসাত্মক ভঙ্গির সাহায্যে তিনি বাংলা গদ্যকে নতুন করে প্রাণদান করেন।

‘ভারতী’ (১৮৭৭) পত্রিকায় প্রকাশিত ‘হালখাতা’ তাঁর চলিত রীতির প্রথম রচনা। পরে তা ‘বীরবলের হালখাতা” নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক ‘সবুজপত্র’ নামক সাহিত্য পত্রিকা। পত্রিকাটি বাংলা গদ্যের উন্নতি সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রমথ চৌধুরীর উলে- খযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে: ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ (১৯১৩), ‘বীরবলের হালখাতা’ (১৯১৬), ‘চার-ইয়ারী কথা’ (১৯১৬), ‘পদ- চারণ’ (১৯১৯), ‘প্রবন্ধ-সংগ্রহ’ (১৯৫২-৫৩)।

পাঠ পরিচিতি

প্রমথ চৌধুরীর নিজের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার ১৩২১ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ নামক তাঁর প্রবন্ধ প্রথম মুদ্রিত হয়। প্রবন্ধটি মূলত সমালোচনাধর্মী। ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর কবিতা ‘সবুজ পাতার গান। এতে কবি যৌবনের জয়গান করেন এবং যৌবনকে রাজটিকা পরাবার প্রস্তাব দেন। এর সমালোচনায় মুখর হন তৎকালীন কতিপয় ব্যক্তি।

প্রমথ চৌধুরী এই সমালোচকদের বক্তব্যের জবাবে ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধটি রচনা এবং তা ‘বীরবল’ ছদ্মনামে ‘সবুজপত্রে’ প্রকাশ করেন। পরে তা ‘বীরবলের হালখাতা’ গ্রন্থভুক্ত হয়। প্রমথ চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর প্রবন্ধগুলোর সমন্বয়ে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত হয় অতুলচন্দ্র গুপ্ত সংকলিত ‘প্রবন্ধ-সংগ্রহ’ নামক গ্রন্থ। প্রবন্ধটি এর দ্বিতীয় খন্ডের ‘বিচিত্র’ শিরোনামের অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

এখানে মূলত যৌবনের জয়গান করা হয়েছে। মানব জীবনে যৌবনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে প্রবন্ধকার দেখাতে চেয়েছেন যে, যৌবন বয়সের ব্যাপার নয়, মনের ব্যাপার। তিনি মানসিক যৌবন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। ব্যক্তি-জীবনে যেমন, তেমনি সামাজিক জীবনেও এই মানসিক যৌবন প্রতিষ্ঠার কথা ব্যক্ত হয়েছে প্রবন্ধটিতে। সেদিক থেকে প্রবন্ধটির নামকরণ যথাযথ হয়েছে বলা চলে।

প্রবন্ধের সূচনায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা প্রসঙ্গে জনৈক টীকাকারের বক্তব্যের কিছু অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমথ চৌধুরী নিজের অভিমত তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। আমাদের সমাজ জড়তাগ্রস্ত ও স্থবির। কারণ এখানে যৌবনের চতুর্দিকে অদৃশ্য দেয়াল তুলে রাখা হয়। এ সমাজ যৌবনকে আত্তীকরণের বদলে অতিক্রম করতে চায়। ব্যক্তির দৈহিক যৌবন ক্ষণস্থায়ী ও সামান্য। কিন্তু মানসিক যৌবন অপরিসীম এবং এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী।

এই মানসিক যৌবনকে সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি। অথচ, আমাদের শিল্প-সাহিত্যে এর আয়োজন নেই। সংস্কৃত সাহিত্যে যৌবন আছে, কিন্তু তা একান্তই দেহ নির্ভর। সেখানে সৃষ্টিধর্মের চেয়ে ভোগস্পৃহাই অধিক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কৌশাম্বির যুবরাজ উদয়ন ও কপিলাবস্তুর যুবরাজ সিদ্ধার্থ উভয়েই সমসাময়িক ছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্যে সিদ্ধার্থ অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের স্থান অতি সামান্য হলেও উদয়ন-কথকতা এর বহু স্থান জুড়ে।

গৌতম বুদ্ধ ত্যাগ ও নির্বাণ লাভের পথ অনুসরণ করেছেন, আর উদয়ন ছিলেন কামকেলিতে মত্ত। সংস্কৃত সাহিত্যে কামের স্থান হলো, কিন্তু ত্যাগধর্ম মূল্য পেলো না । আমরা যৌবনকে সন্দেহের চোখে দেখি। কারণ সেখানে সৃষ্টিশীলতা কেউ আবিষ্কার করেন নি। যৌবন আমাদের বিচারে উন্মত্ততার প্রতীক, তাই বিপদজনক। পন্ডিতগণ তাই তাঁদের শিল্প-সাহিত্যে শৈশব থেকে এক লাফে বার্ধক্যে পৌঁছতে পরামর্শ দেন।

তাঁদের শিক্ষানীতি ছাত্রদের রাতারাতি ইঁচড়ে পাকা বানাবার জন্যে তৈরি। এর ফলে আমাদের সমগ্র জাতি যেন এক অকাল-বার্ধক্য আর অন্তঃসারশূন্য জ্ঞানভারে নুয়ে পড়ছে এবং এটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে সবার কাছে। অথচ যৌবনে কামের পাশাপাশি আছে প্রেম, ইন্দ্রিয়বিলাসের পাশাপাশি সৃষ্টির প্রেরণা, অদম্য আবেগের পাশাপাশি শান্তির স্থিতি। যৌবনে যাঁরা শুধু নেতি ও উশৃঙ্খলতার গন্ধ খোঁজেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে এর ইতিবাচক দিকটি কৌশলে এড়িয়ে যেতে চান।

কারণ তাঁরা ভয় পান যৌবনকে। এই আতঙ্কগ্রস্ততার ফলে আমাদের জীবন নামক গ্রন্থটির ভূমিকা (শৈশব) আছে, উপসংহার (বার্ধক্য) আছে কিন্তু ভেতরের সব কিছুই পরিত্যাজ্য। অর্থাৎ যৌবন নেই। প্রমথ চৌধুরী এই যৌবনকে যথাযোগ্য মর্যাদা দানের কথা বলেছেন। দৈহিক যৌবন অনিত্য বলে মানসিক যৌবনের বন্দনা করেছেন তিনি। দেহের যৌবন অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করা যায় না, কিন্তু মনের যৌবন দিয়ে অন্যকে উদ্দীপ্ত করা সম্ভব।

সমাজজীবনে প্রতিনিয়ত নতুন চিন্তাধারা, নতুন আশা-আকাক্ষা এবং আত্ম-প্রণোদনা জাগিয়ে একে প্রগতিমুখী করার মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে সম্ভব যথাযথ যৌবন-বন্দনার।

মূলপাঠ

গত মাসের সবুজপত্রে শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যৌবনকে রাজটিকা দেবার প্রস্তাব করেছেন। আমার কোনো টীকাকার বন্ধু এই প্রস্তাবের বক্ষ্যমাণ-রূপ ব্যাখ্যা করেছেন — ‘যৌবনকে টিকা দেওয়া অবশ্যকর্তব্য, তাহাকে বসন্তের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য। এ স্থলে রাজটিকা অর্থ – – রাজা অর্থাৎ যৌবনের শাসনকর্তা কর্তৃক তাহার উপকারার্থে দত্ত যে টিকা, সেই টিকা। উক্ত পদ তৃতীয়াতৎপুরুষ সমাসে সিদ্ধ হইয়াছে।

উলিখিত ভাষ্য আমি রহস্য বলে মনে করতুম যদি-না আমার জানা থাকত যে, এ দেশে জ্ঞানী ব্যক্তিদিগের মতে মনের বসন্তঋতু ও প্রকৃতির যৌবনকাল- – দুই অশায়েস্তা, অতএব শাসনযোগ্য। এ উভয়কে জুড়িতে জুতলে আর বাগ মানানো যায় না; অতএব এদের প্রথমে পৃথক্ ক’রে পরে পরাজিত করতে হয়। বসন্তের স্পর্শে ধরণীর সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে; অবশ্য তাই বলে পৃথিবী তার আলিঙ্গন হতে মুক্তিলাভ করবার চেষ্টা করে না, এবং পোষ-মাসকেও বারোমাস পুষে রাখে না।

শীতকে অতিক্রম করে বসন্তের কাছে আত্মসমর্পণ করায় প্রকৃতি যে অর্বাচীনতার পরিচয় দেয় না, তার পরিচয় ফলে। প্রকৃতির যৌবন শাসনযোগ্য হলেও তাকে শাসন করবার ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই; কেননা, প্রকৃতির ধর্ম মানবধর্মশাস্ত্রবহির্ভূত। সেই কারণে জ্ঞানীব্যক্তিরা আমাদের প্রকৃতির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে বারণ করেন, এবং নিত্যই আমাদের প্রকৃতির উলটো টান টানতে পরামর্শ দেন; এই কারণেই মানুষের যৌবনকে বসন্তের প্রভাব হতে দূরে রাখা আবশ্যক।

অন্যথা, যৌবন ও বসন্ত এ দুয়ের আবির্ভাব যে একই দৈবশক্তির লীলা – এইরূপ একটি বিশ্বাস আমাদর মনে স্থানলাভ করতে পারে।
এ দেশে লোকে যে যৌবনের কপালে রাজটিকার পরিবর্তে তার পৃষ্ঠে রাজদন্ড প্রয়োগ করতে সদাই প্রস্তুত, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। এর কারণ হচ্ছে যে, আমাদের বিশ্বাস মানবজীবনে যৌবন একটা মস্ত ফাঁড়া – কোনোরকমে সেটি কাটিয়ে উঠতে পারলেই বাঁচা যায়।

 

যৌবনে দাও রাজটিকা ১

 

এ অবস্থায় কি জ্ঞানী, কি অজ্ঞানী সকলেই চান যে, একলক্ষে বাল্য হতে বার্ধক্যে উত্তীর্ণ হন। যৌবনের নামে আমরা ভয় পাই, কেননা তার অন্তরে শক্তি আছে। অপরপক্ষে বালকের মনে শক্তি নেই, বৃদ্ধের দেহে শক্তি নেই, বালকের জ্ঞান নেই, বৃদ্ধের প্রাণ নেই। তাই আমাদের নিয়ত চেষ্টা হচ্ছে দেহের জড়তার সঙ্গে মনের জড়তার মিলন করা, অজ্ঞতার সঙ্গে বিজ্ঞতার সন্ধিস্থাপন করা।

তাই আমাদের শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে ইঁচড়ে পাকানো, আর আমাদের সমাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে জাগ দিয়ে পাকানো। আমাদের উপরোক্ত চেষ্টা যে ব্যর্থ হয়নি তার প্রমাণ আমাদের সামাজিক জীবন।

আজকের দিনে এ দেশে রাজনীতির ক্ষেত্রে একদিকে বালক, অপরদিকে বৃদ্ধ; সাহিত্যক্ষেত্রে একদিকে স্কুলবয়, অপরদিকে স্কুলমাস্টার; সমাজে একদিকে বাল্যবিবাহ, অপরদিকে অকালমৃত্যু; ধর্মক্ষেত্রে একদিকে শুধু ইতি ইতি, অপরদিকে শুধু নেতি নেতি ; অর্থাৎ একদিকে লোষ্ট্রকাষ্ঠও দেবতা, অপরদিকে ঈশ্বরও ব্রহ্ম নন। অর্থাৎ আমাদের জীবনগ্রন্থে প্রথমে ভূমিকা আছে, শেষে উপসংহার আছে; ভিতরে কিছু নেই।

এ বিশ্বের জীবনের আদি নেই, অন্ত নেই, শুধু মধ্য আছে; কিন্তু তারই অংশীভূত আমাদের জীবনের আদি আছে, অন্ত আছে; শুধু মধ্য নেই । বার্ধক্যকে বাল্যের পাশে এনে ফেললেও আমরা তার মিলনসাধন করতে পারি নি; কারণ ক্রিয়া বাদ দিয়ে দুটি পদকে জুড়ে এক করা যায় না। তাছাড়া যা আছে তা নেই বললেও তার অস্তিত্ব লোপ হয়ে যায় না। এ বিশ্বকে মায়া বললেও তা অস্পৃশ্য হয়ে যায় না, এবং আত্মাকে ছায়া বললেও তা অদৃশ্য হয়ে যায় না।

বরং কোনো-কোনো সত্যের দিকে পিঠ ফেরালে তা অনেক সময়ে আমাদের ঘাড়ে চড়ে বসে। যে যৌবনকে আমরা সমাজে স্থান দিই নি, তা এখন নানা বিকৃতরূপে নানা ব্যক্তির দেহ অবলম্বন করে রয়েছে। যাঁরা সমাজের সুমুখে জীবনের শুধু নান্দী ও ভরতবচন পাঠ করেন, তাঁদের জীবনের অভিনয়টা যবনিকার অন্তরালেই হয়ে থাকে। রুদ্ধ ও বদ্ধ করে রাখলে পদার্থমাত্রই আলোর ও বায়ুর সম্পর্ক হারায়, এবং সেইজন্য তার গায়ে কলঙ্ক ধরাও অনিবার্য। গুপ্ত জিনিসের পক্ষে দুষ্ট হওয়া স্বাভাবিক।

আমরা যে যৌবনকে গোপন করে রাখতে চাই, তার জন্য আমাদের প্রাচীন সাহিত্য অনেক পরিমাণে দায়ী। কোনো বিখ্যাত ইংরেজ লেখক বলেন যে, literature হচ্ছে criticism of life; ইংরেজি সাহিত্য জীবনের সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্য হচ্ছে যৌবনের আলোচনা। সংস্কৃত সাহিত্যে যুবকযুবতী ব্যতীত আর কারও স্থান নেই। আমাদের কাব্যরাজ্য হচ্ছে সূর্যবংশের শেষ নৃপতি অগ্নিবর্ণের রাজ্য, এবং সে দেশ হচেছ অষ্টাদশবর্ষদেশীয়াদের স্বদেশ।

যৌবনের যে ছবি সংস্কৃত দৃশ্য কাব্যে ফুটে উঠেছে, সে হচ্ছে ভোগবিলাসের চিত্র। সংস্কৃত কাব্যজগৎ মাল্যচন্দনবনিতা দিয়ে গঠিত এবং সে জগতের বনিতাই হচ্ছে স্বর্গ, ও মাল্যচন্দন তার উপসর্গ। এ কাব্যজগতের স্রষ্টা কিংবা দ্রষ্টা কবিদের মতে প্রকৃতির কাজ হচ্ছে শুধু রমণীদেহের উপমা জোগানো, পুরুষের কাজ শুধু রমণীর মন জোগানো।

হিন্দুযুগের শেষ কবি জয়দেব নিজের কাব্যসম্বন্ধে স্পষ্টাক্ষরে যে কথা বলেছেন, তাঁর পূর্ববর্তী কবিরাও ইঙ্গিতে সেই একই কথা বলেছেন। সে কথা এই যে, , ‘যদি বিলাস-কলায় কুতূহলী হও তো আমার কোমলকান্ত পদাবলী শ্রবণ করো।’ এককথায় যে যৌবন য্যাতি নিজের পুত্রদের কাছে ভিক্ষা করেছিলেন, সংস্কৃত কবিরা সেই যৌবনেরই রূপগুণ বর্ণনা করেছেন।

এ কথা যে কত সত্য, তা একটি উদাহরণের সাহায্যে প্রমাণ করা যেতে পারে। কৌশাম্বির যুবরাজ উদয়ন এবং কপিলাবস্তুর যুবরাজ সিদ্ধার্থ উভয়ে সমসাময়িক ছিলেন। উভয়েই পরম রূপবান্ এবং দিব্য শক্তিশালী যুবাপুরুষ; কিন্তু উভয়ের মধ্যে প্রভেদ এইটুকু যে, একজন হচ্ছেন ভোগের আর একজন হচ্ছেন ত্যাগের পূর্ণ অবতার।

ভগবান গৌতমবুদ্ধের জীবনের ব্রত ছিল মানবের মোহনাশ করে তাকে সংসারের সকল শৃঙ্খল হতে মুক্ত করা; আর বৎসরাজ উদয়নের জীবনের ব্রত ছিল ঘোষবর্তী বীণার সাহায্যে অরণ্যের গজকামিনী এবং অন্তঃপুরের গজগামিনীদের প্রথমে মুগ্ধ ক’রে পরে নিজের ভোগের জন্য তাদের অবরুদ্ধ করা। অথচ সংস্কৃত কাব্যে বুদ্ধচরিতের স্থান নেই, কিন্তু উদয়নকথায় তা পরিপূর্ণ ।

সংস্কৃত ভাষায় যে বুদ্ধের জীবনচরিত লেখা হয়নি, তা নয়; তবে ললিতবিস্তরকে আর কেউ কাব্য বলে স্বীকার করবেন না, এবং অশ্বঘোষের নাম পর্যন্তও লুপ্ত হয়ে গেছে। অপরদিকে উদয়ন – বাসবদত্তার কথা অবলম্বন করে যাঁরা কাব্যরচনা করেছেন, যথা ভাস গুণাঢ্য সুবন্ধু ও শ্রীহর্ষ ইত্যাদি, তাঁদের বাদ দিলে সংস্কৃত সাহিত্যের অর্ধেক বাদ পড়ে যায়।

কালিদাস বলেছেন যে, কৌশাম্বির গ্রামবৃদ্ধেরা উদয়নকথা শুনতে ও বলতে ভালোবাসতেন; কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কেবল কৌশাম্বির গ্রামবৃদ্ধ কেন, সমগ্র ভারতবর্ষের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই ঐ কথা-রসের রসিক। সংস্কৃত সাহিত্য এ সত্যের পরিচয় দেয় না যে, বুদ্ধের উপদেশের বলে জাতীয় জীবনে যৌবন এনে দিয়েছিল, এবং উদয়নের দৃষ্টান্তের ফলে অনেকের যৌবনে অকালবার্ধক্য এনে দিয়েছিল।

বৌদ্ধধর্মের অনুশীলনের ফলে রাজা অশোক লাভ করেছিলেন সাম্রাজ্য; আর উদয়নধর্মের অনুশীলন করে রাজা অগ্নিবর্ণ লাভ করেছিলেন রাজযক্ষ্মা। সংস্কৃত কবিরা এ সত্যটি উপেক্ষা করেছিলেন যে, ভোগের ন্যায় ত্যাগও যৌবনেরই ধর্ম। বার্ধক্য কিছু অর্জন করতে পারে না ব’লে কিছু বর্জনও করতে পারে না। বার্ধক্য কিছু কাড়তে পারে না ব’লে কিছু ছাড়তেও পারে না – দুটি কালো চোখের জন্যও নয়, বিশ কোটি কালো লোকের জন্যও নয়।

শব্দার্থ ও টীকা

সবুজপত্র – প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষায় চলিত গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠায় এই পত্রিকা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে এক লেখক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন পত্রিকাটির নিয়মিত লেখক।

সত্যেন্দ্ৰনাথ দত্ত – জন্ম ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে, মৃত্যু ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক কবি, তবে রবীন্দ্রানুসারী নন। কবিতায় নানা ধরনের ছন্দের সফল ব্যবহারের জন্যে তিনি ‘ছন্দের যাদুকর’ বলে পরিচিত।

রাজটিকা – রাজ্যাভিষেককালে রাজার ললাটে অঙ্কিত তিলক। এখানে স্বীকৃতি’ অর্থে।

জুড়িতে জুতলে— একত্রে গ্রহণ করলে। এখানে প্রাকৃতিক যৌবন বসন্তকাল ও মানবের যৌবনকে গাড়ির পাশাপাশি দুই গরুর মতো সম্মিলনের কথা বলা হয়েছে। মানবধর্মশাস্ত্রবহির্ভূত – মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ও আচরিত রীতিনীতির বাইরে। প্রযোজ্য।

রাজদন্ড – রাজপদের নিদর্শনস্বরূপ রাজা যে দন্ড হস্তে বহন করেন; রাজবিধি অনুযায়ী শাস্তি। — এখানে দ্বিতীয় অর্থটি

লোষ্ট্রকাষ্ঠ – পাথর ও গাছপালা ইত্যাদি।

নান্দী – নাটকের প্রারম্ভে মঙ্গলাচরণ।

ভরতবচন – নাটক শেষে মঙ্গল কামনা।

অগ্নিবর্ণ – সংস্কৃত কবি কালিদাস রচিত ‘রঘুবংশ’ মহাকাব্যের একটি চরিত্র। এখানে উলেখ আছে, রাজা সুদর্শনের পুত্র – অগ্নিবর্ণ অর্থাৎ রাম। তাঁর রাজ্যে দৈহিক যৌবনের বড় বাড়াবাড়ি ছিলো।

অষ্টাদশবর্ষীদেশীয়াদের স্বদেশ— অগ্নিবর্ণের রাজ্য। সেখানে আঠার বছর বয়সী যুবতীদের প্রাধান্য ছিলো এবং তারা
কামকেলিতে মত্ত থাকতো ।

মাল্যচন্দনবনিতা— মালা চন্দন ও নারী।

জয়দেব—মাদশ শতকের সংস্কৃত কবি। তিনি রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি ছিলেন। ‘গীতগোবিন্দম্ তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থে রাধা ও কৃষ্ণের প্রণয়লীলাকে উপলক্ষ করে আদিরসই প্রাধান্য পেয়েছে।

বিলাস-কলায় কুতূহলী হওয়া— মিলন বা প্রমোদের চরম মুহূর্ত সম্পর্কে অধিকতর আগ্রহান্বিত হওয়া।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের উত্তর লিখুন

১. আমাদের সমাজে প্রাচীনপন্থী পন্ডিতগণ যৌব-ধৰ্ম বলতে প্রধানত কী বুঝিয়ে থাকেন ?

২. সমাজে যৌবনের দুষ্ট প্রকাশ ঘটে কেন?

৩. সংস্কৃত কবিগণ যৌবনের কোন্ দিকটিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন?

৪. যৌবনের প্রকৃত ধর্ম কি?

২ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-উত্তর:

‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন যে, গুপ্ত জিনিসের পক্ষে দুষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। যৌবনকে গুপ্ত অবস্থায় রাখলে সে-ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। প্রকৃতপক্ষে, মানুষের জীবনে তার যৌবনকাল আগমন এক অনিবার্য সত্য। প্রকৃতিতে যেমন বসন্তকাল আসে মানবজীবনেও তেমনি আসে যৌবনকাল। কিন্তু প্রাচীনপন্থী পন্ডিত বা সমাজপতিদের বিবেচনায় মানুষের যৌবন অনেক ক্ষেত্রে ধর্মশাস্ত্রবহির্ভূত কার্যে লিপ্ত হয়।

তাই তারা পারতপক্ষে যৌবধর্মকে গুপ্ত রাখতে চান। তাদের তৈরি সমাজ বা শিক্ষানীতিতে বালককে এক ধাপে বার্ধক্যে পৌঁছে যাবার পরামর্শ দেয়া হয়। এ কারণে যৌবন থেকে যায় গুপ্ত আর বালক প্রকৃত যুবক হবার বদলে হয়ে ওঠে ইঁচড়ে পাকা। এরাই সমাজে ও ব্যক্তিজীবনেও নানা অপরাধের জন্ম দিয়ে থাকে। পদার্থের ধর্ম যেমন, মানুষের মনোগত বৈশিষ্ট্যও তেমনি- এর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হলে তার উল্টো ফল ফলে।

প্রসঙ্গ উলেখ করে ব্যাখ্যা লিখুন

১. যৌবনের টিকা দেওয়া অবশ্যকর্তব্য, তাহাকে বসন্তের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য।

২. আমাদের জীবনগ্রন্থে প্রথমে ভূমিকা আছে, শেষে উপসংহার আছে, ভিতরে কিছু নেই ।

৩. গুপ্ত জিনিসের পক্ষে দুষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। ৪. ভোগের ন্যায় ত্যাগও যৌবনের ধর্ম।

 

যৌবনে দাও রাজটিকা ১

 

২ নং ব্যাখ্যার নমনা-উত্তর

উদ্ধৃতাংশটুকু প্রথম চৌধুরীর ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এই বাক্যটির মাধ্যমে প্রবন্ধকার আমাদের যৌবধর্ম পরিত্যাগী অন্তঃসারশূন্য জীবনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, কোন গ্রন্থের রূপকাশ্রয়ে। সমাজপতি ও তথাকথিত পণ্ডিতদের দেয়া ধারণা অনুসারে জীবন সম্পর্কে আমাদের এক অদ্ভুত বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের এই জীবনদৃষ্টিতে মনুষ্যকালের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকে উপেক্ষার কথা আছে।

যৌবন সমস্ত অনাসৃষ্টির মূলে এবং যৌবন ধর্মশাস্ত্রবহির্ভূত যাবতীয় কর্মের উদ্‌গাতা। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে আমরা প্রাচীন পন্ডিতদের মত মান্য করে ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবন থেকে যৌবনকে নির্বাসন দিয়েছি। এর ফলে আমাদের বাল্য ও বার্ধক্যকাল থাকলেও যৌবনবিহীন জীবনযাপন চলছে দিনের পর দিন। প্রাবন্ধিক একটি গ্রন্থের রূপকে আমাদের জীবনের প্রসঙ্গ এনেছেন ।

এখানে বাল্যকালস্বরূপ ভূমিকা, বার্ধক্যকালস্বরূপ উপসংহার থাকলেও যৌবধর্মবিহীন অন্তঃসারশূন্যতা বিরাজিত। প্রমথ চৌধুরী উপর্যুক্ত বাক্যের মাধ্যমে জীবনের এই অন্তঃসারশূন্যতার বিরুদ্ধে শেষ প্রকাশ করেছেন।

 

 

মূল পাঠ

পাছে লোকে ভুল বোঝেন বলে এখানে আমি একটি কথা বলে রাখতে চাই। কেউ মনে করবেন না যে, আমি কাউকে সংস্কৃত কাব্য বয়কট করতে বলছি কিংবা নীতি ও রুচির দোহাই দিয়ে সে কাব্যের সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশ করবার পরামর্শ দিচ্ছি। আমার মতে যা সত্য তা গোপন করা সুনীতি নয় এবং তা প্রকাশ করাও দুর্নীতি নয়। সংস্কৃতকাব্যে যে যৌবনধর্মের বর্ণনা আছে তা যে সামান্য মানবধর্ম, এ হচ্ছে অতি স্পষ্ট সত্য; এবং মানবজীবনের উপর তার প্রভাব যে অতি প্রবল, তাও অস্বীকার করবার জো নেই।

তবে এই একদেশদর্শিতা ও অত্যুক্তি ভাষায় যাকে বলে একরোখামি ও বাড়াবাড়ি, তাই – হচ্ছে সংস্কৃত কাব্যের প্রধান দোষ। যৌবনের স্থূল শরীরকে অত আশকারা দিলে তা উত্তরোত্তর স্থূল হতে স্থূলতর হয়ে ওঠে, এবং সেই সঙ্গে তার সূক্ষ্ম শরীরটি সূক্ষ্ম হতে এত সূক্ষ্মতম হয়ে ওঠে যে, তা খুঁজে পাওয়াই ভার হয়।

সংস্কৃত সাহিত্যের অবনতির সময় কাব্যে রক্তমাংসের পরিমাণ এত বেড়ে গিয়েছিল যে, তার ভিতর আত্মার পরিচয় দিতে হলে সেই রক্তমাংসের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করা ছাড়া আর আমাদের উপায় নেই। দেহকে অতটা প্রাধান্য দিলে মন-পদার্থটি বিগড়ে যায়; তার ফলে দেহ ও মন পৃথক্ হয়ে যায় এবং উভয়ের মধ্যে আত্মীয়তার পরিবর্তে জ্ঞাতিশত্রুতা জন্মায়।

সম্ভবতঃ বৌদ্ধধর্মের নিরামিষের প্রতিবাদস্বরূপ হিন্দু কবিরা তাঁদের কাব্যে এতটা আমিষের আমদানি করেছিলেন। কিন্তু যে কারণেই হোক প্রাচীন ভারতবর্ষের চিন্তার রাজ্যে দেহমনের পরস্পরের যে বিচ্ছেদ ঘটেছিল, তার প্রমাণ – – প্রাচীন সমাজের একদিকে বিলাসী অপরদিকে সন্ন্যাসী, একদিকে পত্তন অপরদিকে বন, একদিকে রঙ্গালয় অপরদিকে হিমালয়; এক কথায় এক দিকে কামশাস্ত্র অপরদিকে মোক্ষশাস্ত্র।

মাঝামাঝি আর কিছু জীবনে থাকতে পারত, কিন্তু সাহিত্যে নেই। এবং এ দুই বিরুদ্ধ- মনোভাবের পরস্পর-মিলনের যে কোনো পন্থা ছিল না, সে কথা ভর্তৃহরি স্পষ্টাক্ষরে বলেছেন – একা ভার্যা সুন্দরী বা দরী বা এই হচ্ছে প্রাচীনযুগের শেষ কথা। যাঁরা দরী-প্রাণ তাঁদের পক্ষে যৌবনের নিন্দা করা যেমন স্বাভাবিক, যাঁরা সুন্দরী-প্রাণ তাঁদের পক্ষেও তেমনি স্বাভাবিক। যতির মুখের যৌবন-নিন্দা অপেক্ষা কবির মুখের যৌবন-নিন্দায়, আমার বিশ্বাস, অধিক ঝাঁজ আছে।

তার কারণ, ত্যাগীর অপেক্ষা ভোগীরা অভ্যাসবশতঃ কথায় ও কাজে বেশি অসংযত। যাঁরা স্ত্রীজাতিকে কেবলমাত্র ভোগের সামগ্রী মনে করেন তাঁরাই যে স্ত্রী-নিন্দার ওস্তাদ, এর প্রমাণ জীবন ও সাহিত্যে নিত্য পাওয়া যায়। স্ত্রী-নিন্দুকের রাজা হচ্ছেন রাজকবি ভর্তৃহরি ও রাজকবি সোলোমন। চরম ভোগবিলাসে পরম চরিতার্থতা লাভ করতে না পেরে এঁরা শেষ বয়সে স্ত্রী-জাতির উপর গায়ের ঝাল ঝেড়েছেন।

যাঁরা বনিতাকে মাল্যচন্দন হিসাবে ব্যবহার করেন তাঁরা শুকিয়ে গেলে সেই বনিতাকে মাল্যচন্দনের মতই ভূতলে নিক্ষেপ করেন, এবং তাকে পদদলিত করতেও সংকুচিত হন না। প্রথমবয়সে মধুর রস অতিমাত্রায় চর্চা করলে শেষ বয়সে জীবন তিতো হয়ে ওঠে। এ শ্রেণীর লোকের হাতে শৃঙ্গার-শতকের পরেই বৈরাগ্য-শতক রচিত হয়। একই কারণে, , যাঁরা যৌবনকে কেবলমাত্র ভোগের উপকরণ মনে করেন তাঁদের মুখে যৌবন-নিন্দা লেগে থাকবারই কথা।

যাঁরা যৌবন জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেন, তারা ভাটার সময় পাকে পড়ে গত জোয়ারের প্রতি কটুকাটব্য প্রয়োগ করেন। যৌবনের উপর তাঁদের রাগ এই যে, তা পালিয়ে যায় এবং একবার চলে গেলে আর ফেরে না। যযাতি যদি পুরুর কাছে ভিক্ষা করে যৌবন ফিরে না পেতেন তা হলে তিনি যে কাব্য কিংবা ধর্মশাস্ত্র রচনা করতেন, তাতে যে কি সুতীব্র যৌবন- নিন্দা থাকত তা আমরা কল্পনাও করতে পারি নে।

পুরু যে পিতৃভক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন, তার ভিতর পিতার প্রতি কতটা ভক্তি ছিল এবং তাতে পিতারই যে উপকার করা হয়েছিল তা বলতে পারি নে, কিন্তু তাতে দেশের মহা অপকার হয়েছে; কারণ নীতির একখানা বড় গ্রন্থ মারা গেছে। যযাতি-কাঙ্ক্ষিত যৌবনের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ এই যে, তা অনিত্য। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণ ও শ্রমণ, নগ্নক্ষপণক ও নাগরিক, সকলেই একমত।

‘যৌবন ক্ষণস্থায়ী”, এই আক্ষেপে এ দেশের কাব্য ও সংগীত পরিপূর্ণ – ফাগুন গয়ী হয়, বহুরা ফিরি আয়ী হয় গয়ে রে যোবন, ফিরি আওত নাহি এই গান আজও হিন্দুস্থানের পথে-ঘাটে অতি করুণ সুরে গাওয়া হয়ে থাকে। যৌবন যে চিরদিন থাকে না, এ আপসোস রাখবার স্থান ভারতবর্ষে নেই।যা অতি প্রিয় এবং ক্ষণস্থায়ী, তার স্থায়িত্ব বাড়াবার চেষ্টা মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। সম্ভবতঃ নিজের অধিকার বিস্তার করবার উদ্দেশ্যেই এ দেশে যৌবন শৈশবের উপর আক্রমণ করেছিল।

বাল্যবিবাহের মূলে হয়তো এই যৌবনের মেয়াদ বাড়াবার ইচ্ছাটাই বর্তমান। জীবনের গতিটি উলটো দিকে ফেরাবার ভিতরও একটা মহা আর্ট আছে। পৃথিবীর অপরসব দেশে লোকে গাছকে কি করে বড় করতে হয় তারই সন্ধান জানে, কিন্তু গাছকে কি করে ছোট করতে হয় সে কৌশল শুধু জাপানিরাই জানে। একটি বটগাছকে তারা চিরজীবন একটি টবের ভিতরে পুরে রেখে দিতে পারে। শুনতে পাই, এই সব বামন-বট হচ্ছে অক্ষয়বট।

জাপানিদের বিশ্বাস যে, গাছকে হ্রস্ব করলে তা আর বৃদ্ধ হয় না। সম্ভবত: আমাদেরও মনুষ্যত্বের চর্চা সম্বন্ধে এই জাপানি আর্ট জানা আছে, এবং বাল্যবিবাহ হচ্ছে সেই আর্টের একটি প্রধান অঙ্গ। এবং উক্ত কারণেই, অপর-সকল প্রাচীন সমাজ উৎসন্নে গেলেও আমাদের সমাজ আজও টিকে আছে।

মনুষ্যত্ব খর্ব করে মানবসমাজকে টবে জিইয়ে রাখায় যে বিশেষ কিছু অহংকার করবার আছে, তা আমার মনে হয় না। সে যাই হোক, এ যুগে যখন কেউ যৌবনকে রাজটিকা দেবার প্রস্তাব করেন তখন তিনি সমাজের কথা ভাবেন, ব্যক্তিবিশেষের কথা নয়। ব্যক্তিগত হিসেবে জীবন ও যৌবন অনিত্য হলেও মানবসমাজের হিসেবে ও-দুই পদার্থ নিত্য বললেও অত্যুক্তি হয় না। সুতরাং সামাজিক জীবনে যৌবনের প্রতিষ্ঠা করা মানুষের ক্ষমতার বহির্ভূত না হলেও না হতে পারে ।

কি উপায়ে যৌবনকে সমাজের যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করা যেতে পারে তাই হচ্ছে বিবেচ্য ও বিচার্য। এ বিচার করবার সময় এ কথাটি মনে রাখা আবশ্যক যে, মানবজীবনের পূর্ণ অভিব্যক্তি- – যৌবন । যৌবনে মানুষের বাহ্যেন্দ্রিয় কর্মেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয় সব সজাগ ও সবল হয়ে ওঠে, এবং সৃষ্টির মূলে যে প্রেরণা আছে মানুষে সেই প্রেরণা তার সকল অঙ্গে সকল মনে অনুভব করে । দেহ ও মনের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধের উপর মানবজীবন প্রতিষ্ঠিত হলেও দেহমনের পার্থক্যের উপরেই আমাদের চিন্তারাজ্য প্রতিষ্ঠিত।

দেহের যৌবনের সঙ্গে মনের যৌবনের একটা যোগাযোগ থাকলেও দৈহিক যৌবন ও মানসিক যৌবন স্বতন্ত্র। এই মানসিক যৌবন লাভ করতে পারলেই আমরা তা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারব। দেহ সংকীর্ণ ও পরিচ্ছিন্ন ; মন উদার ও ব্যাপক। একের দেহের যৌবন অপরের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেবার জো নেই; কিন্তু একের মনের যৌবন লক্ষ লোকের মনে সংক্রমণ করে দেওয়া যেতে পারে। পূর্বে বলেছি যে, দেহ ও মনের সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য।

একমাত্র প্রাণশক্তিই জড় ও চৈতন্যের যোগ সাধন করে। যেখানে প্রাণ নেই সেখানে জড়ে ও চৈতন্যে মিলনও দেখা যায় না। প্রাণই আমাদের দেহ ও মনের মধ্যে মধ্যস্থতা করছে। প্রাণের পায়ের নীচে হচ্ছে জড়জগৎ আর তার মাথার উপরে মনোজগৎ। প্রাণের ধর্ম যে জীবনপ্রবাহ রক্ষা করা, নবনব সৃষ্টির সারা সৃষ্টি রক্ষা করা – এটি সর্বলোকবিদিত। কিন্তু প্রাণের আর একটি বিশেষ ধর্ম আছে, যা সকলের কাছে সমান প্রত্যক্ষ নয়।

সেটি হচ্ছে এই যে, প্রাণ প্রতি মুহূর্তে রূপান্তরিত হয়। হিন্দুদর্শনের মতে জীবের প্রাণময় কোষ, অন্নময় কোষ ও মনোময় কোষের মধ্যে অবস্থিত। প্রাণের গতি উভয়মুখী। প্রাণের পক্ষে মনোময় কোষে ওঠা এবং অন্নময় কোষে নামা দুই সম্ভব। প্রাণ অধোগতি প্রাপ্ত হয়ে জড়জগতের অন্তর্ভূত হয়ে যায়; আর উন্নত হয়ে মনোজগতের অন্তর্ভূত হয়। মনকে প্রাণের পরিণতি এবং জড়কে প্রাণের বিকৃতি বললেও অত্যুক্তি হয় না।

প্রাণের স্বাভাবিক গতি হচ্ছে মনোজগতের দিকে; প্রাণের স্বাধীন স্ফূর্তিতে বাধা দিলেই তা জড়তাপ্রাপ্ত হয়। প্রাণ নিজের অভিব্যক্তির নিয়ম নিজে গড়ে নেয়; বাইরের নিয়মে তাকে বন্ধ করাতেই সে জড় জগতের অধীন হয়ে পড়ে। যেমন প্রাণিজগতের রক্ষার জন্য নিত্যনূতন প্রাণের সৃষ্টি আবশ্যক, এবং সে সৃষ্টির জন্য দেহের যৌবন চাই, তেমনি মনোজগতের এবং তদধীন কর্মজগতের রক্ষার জন্য সেখানেও নিত্য নব সৃষ্টির আবশ্যক, এবং সে সৃষ্টির জন্য মনের যৌবন চাই।

পুরাতনকে আঁকড়ে থাকাই বার্ধক্য অর্থাৎ জড়তা। মানসিক যৌবন লাভের জন্য প্রথম আবশ্যক – – প্রাণশক্তি যে দৈবী শক্তি – এই বিশ্বাস। পারে, তাই হচ্ছে এই মানসিক যৌবনই সমাজে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে আমাদের উদ্দেশ্য। এবং কি উপায়ে তা সাধিত হতে আলোচ্য।

শব্দার্থ ও টীকা

একদেশদর্শিতা – কোনো বিষয়ের একাংশমাত্র বিবেচনা না করা, সংকীর্ণতা, পক্ষপাতদুষ্টতা।

মোক্ষশাস্ত্র — ভববন্ধন হতে মুক্তির আচরণবিধি ।

ভর্তৃহরি — সংস্কৃত কবি। রাজা বিক্রমাদিত্যের পিতা গন্ধর্ব সেনের দাসীপুত্র।

সোলোমন — একজন রাজকবি ।

শৃঙ্গার-শতক ও বৈরাগ্য-শতক — সংস্কৃত কবি ভর্তৃহরি কর্তৃক রচিত দুটো কাব্যগ্রন্থ। ‘নীতি-শতক’ নামে তাঁর আরও একটি কাব্যগ্রন্থ আছে।

কুটকাটব্য — কড়া কথা, গালমন্দ ।

যযাতি-কাঙিক্ষত – যযাতি যা কামনা করেছেন।

শ্রমণ — বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, ভিক্ষু।

নগ্নক্ষপণক — উলঙ্গ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীবিশেষ। – ‘ফাগুন গয়ী হয়, বহুরা ফিরি আয়ী হয় / গয়ে রে যৌবন, ফিরি আওত নাহি— ফাল্গুন চলে যায় সত্যি, কিন্তু তা বার বার ফিরে আসে। যৌবন চলে গেলে তা আর কখনো আসে না ফিরে।

অক্ষয়বট – ভুবনেশ্বর, প্রয়াস, পুরী প্রভৃতি তীর্থস্থানের প্রাচীন বটবৃক্ষ। মনে করা হয়, এই বটবৃক্ষের মূলে জলসেচন
করে প্রার্থনা করলে অক্ষয় পূণ্য লাভ হয়।

অভিষিক্ত — গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির জন্যে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানকে বলে অভিষেক। অনুষ্ঠান সমাপনান্তে ওই –
ব্যক্তিটি হল অভিষিক্ত।

বাহ্যেন্দ্রিয়- চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক- – এই পঞ্চ ইন্দ্ৰিয়।

কর্মেন্দ্রিয় — যে সব ইন্দ্রিয়শারা কর্ম সম্পাদন করা হয়। যেমন, বাক্, , পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ।

অন্তরিন্দ্রিয় — মন, অন্তকরণ।

পরিচ্ছিন্ন — সীমাবদ্ধ।

 

যৌবনে দাও রাজটিকা ২

 

বস্তুসংক্ষেপ

সংস্কৃত সাহিত্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার প্রবন্ধকারের লক্ষ্য নয়, বরং সেখানে মানবধর্মের অতি সামান্য অংশ দেহজ যৌবনের যে বাড়াবাড়ি সে কথাই তিনি ব্যক্ত করেছেন। যৌবন মানেই শুধু স্থূল শরীর নয়, এসত্যটি সংস্কৃত কবিগণ বুঝতে চান নি। পরে অবশ্য এই রক্তমাংসের বাড়াবাড়ির একটা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ভারতের প্রাচীন সাহিত্যে তাই একদিকে কাম অন্যদিকে মোক্ষ বা পরিত্রাণের কথা আছে, এর মাঝামাঝি কিছু নেই।

ভর্তৃহরি, সোলোমান প্রমুখ রাজকবিও শুধু দেহের বন্দনা করেছেন ও স্ত্রী-জাতিকে ভোগের সামগ্রী করে তুলেছেন। যৌবন থেকে পালিয়ে গুহা- আশ্রয়ী সন্ন্যাসী যেমন যৌবনের নিন্দা করেছেন, তেমনি ভোগে পরিতৃপ্ত না হয়ে ভোগীও যৌবন-নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। কিন্তু তবুও এ দেশের মানুষ যৌবনের পরিধি বিস্তৃতির জন্যে বাল্যবিবাহ সমর্থন করে। অথচ এই যৌবনকে বার্ধক্য পর্যন্ত প্রসারিত করার কোন উদ্যোগ নেই তাদের।

প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিজীবন থেকে সমাজজীবনে যদি এই যৌবন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়, তা হলেই এই ইতিনেতির অবসান হতে পারে। কিন্তু এ এক কঠিন পাঠ। মানবজীবনের পূর্ণ অভিব্যক্তি তার যৌবন, যখন তার বাহ্য, কর্ম ও অন্তরিন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে। এ সময় তার মনোজগতেরও বিকাশ ঘটে। এতোদিন শরীরকে নির্ভর করে যৌবনের প্রশস্তি রচনা করা হয়েছে, যেখানে মন ছিলো সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত।

অথচ দেহ সংকীর্ণ ও পরিচ্ছিন্ন, অন্যদিকে মন উদার ও ব্যাপক। এই মানসিক যৌবন লাভ করতে পারলেই তা সমাজে প্রতিষ্ঠা সম্ভব। দেহের যৌবন অন্যের দেহে সংক্রমিত করা যায় না, কিন্তু মনের যৌবন দিয়ে অন্যকে মানসিকভাবে উদ্দীপ্ত করা যায়। দেহের যৌবন ও মনের যৌবন পরস্পর বিরোধী কোন কিছু নয়। প্রাণিজগত রক্ষা ও প্রাণের সৃষ্টির জন্যে যেমন দেহের যৌবন দরকার, তেমনি মনোজগত ও কর্মজগত রক্ষার জন্যে প্রয়োজন মনের যৌবন।

প্রমথ চৌধুরী ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণতায়, যুক্তির শাণিত ধারায় ও বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্যে প্রবন্ধে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করে স্পষ্ট বলেছেন যে, সমাজে মানসিক যৌবন প্রতিষ্ঠাই তাঁর উদ্দেশ্য। এ মানসিক যৌবনের সাহায্যেই কর্মে ও জ্ঞানে সামাজিক মানুষের মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ ফল লাভ করা সম্ভব। এরূপ যৌবনের রাজটিকা পরিয়ে অভিষিক্ত করতে নিশ্চয়ই কেউ আপত্তি করবে না, শুধু জড়বাদী ও মায়াবাদীগণ ছাড়া। কারণ এরা প্রাণের স্বতন্ত্র মূল্যে বিশ্বাসী নয় ।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

সংক্ষিপ্ত-উত্তরমূলক প্রশ্ন

১. প্রথম চৌধুরীর বিচারে সংস্কৃত কাব্যের প্রধান দোষ কি?

২. গুহাবাসী সন্ন্যাসীর যৌবন পরিত্যাগ ও যৌবনে অতি দেহভোগকারী উভয়েই যৌবন-নিন্দা করে, কেন?

৩. দেহের যৌবন থেকে মনের যৌবন স্বতন্ত্র, কোন অর্থে? ৪. সমাজের মানসিক যৌবন প্রতিষ্ঠার উপায় কি?

২ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-উত্তর:

মানবজীবন দেহ ও মনের সংযোগে গঠিত। তারপরও একথা বলা যায় যে, মানুষের চিন্তার জগত দেহসম্পৃক্ত নয়। যৌবন মনুষ্যকালের সর্বশেষ্ঠ সময়। মানুষের বাহ্যেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয় এ সময় অধিক সজাগ ও কর্মঠ থাকে। দৈহিক যৌবন এরপারা অনেকটা প্রকাশিত হয়। কিন্তু অন্তরিন্দ্রিয় বলেও মানুষের একটি বিশেষ দিক থাকে। এ সময় তারও জাগরণ ঘটে। দেহের যৌবন একটি নির্দিষ্ট বয়ঃসীমা অতিক্রান্তির পরই অস্তমিত হয়; শিথিল হয়ে পড়ে ইন্দ্রিয়-শক্তি।

তাছাড়া দেহ এক অর্থে সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধও বটে। কিন্তু মানুষের অন্তরিন্দ্রিয় অর্থাৎ মনোজাগতিক যৌবন বয়সে সীমাবদ্ধ নয় বলে মৃত্যুর পূর্ব অবধি এই যৌবন ধারণ করা সম্ভব। তাছাড়া দেহের মতো মন সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ নয়। এতে উদারতা ও ব্যাপকতার স্থান রয়েছে। মনের যৌবন এক থেকে বহুজনে সংক্রমিত করা যেতে পারে, কিন্তু দেহের যৌবন একদেহেই স্থাণু।

আবার ওই দেহের বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যৌবন নিশ্চিতভাবে অন্তগামী হয়ে পড়ে। মনের যৌবন সামাজিক বহুমানুষের মধ্যে সংক্রমিত করে সমাজে যৌবশক্তি সঞ্চার ঘটানো যায়। কিন্তু ব্যক্তিদেহের যৌবন থেকে তা একেবারেই অসম্ভব। এ সব কারণেই বলা চলে দেহের যৌবন ও মনের যৌবন স্বতন্ত্র।

প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা লিখুন

১. মনুষ্যত্ব খর্ব করে মানবসমাজকে টবে জিইয়ে রাখায় যে বিশেষ কিছু অহংকার করার আছে, তা আমার মনে হয় না।

২. একের দেহের যৌবন অপরের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেবার জো নেই; কিন্তু একের মনের যৌবন লক্ষ লোকের মনে সংক্রমণ করে দেওয়া যেতে পারে।

৩. প্রাণের স্বাভাবিক গতি হচ্ছে মনোজগতের দিকে; প্রাণের স্বাধীন স্ফূর্তিতে বাধা দিলেই তা জড়তাপ্রাপ্ত হয়।

৪. মানসিক যৌবন লাভের জন্যে প্রথম আবশ্যক – প্রাণশক্তি যে দৈবী শক্তি এই বিশ্বাস।

৫. সমগ্র সমাজের এই জীবন প্রবাহ যিনি নিজের অন্তরে টেনে নিতে পারবেন, তার মনের যৌবনের আর ক্ষয়ের আশঙ্কা নেই ।

৪ নং ব্যাখ্যার নমুনা-উত্তর

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক প্রথম চৌধুরীর ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধ থেকে উপর্যুক্ত বাক্যটি উদ্ধৃত করা হয়েছে। এখানে প্রবন্ধকার বলেছেন যে, মানসিক যৌবন লাভের জন্যে দৈবশক্তির মতো একটি অমিত তেজ মনুষ্যপ্রাণে অনুভূত হওয়া জরুরি। গতিশীলতা ও পরিবর্তনশীলতাই প্রাণের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কারণ প্রাণ জড় পদার্থ নয়। তবে পৃথিবীর বস্তু ও প্রাণিজগতের সান্নিধ্যে নানা লীলাবৈচিত্র্যের মধ্যদিয়েই প্রাণের বহুবিচিত্র বিকাশ ঘটে।

প্রাণ নিজের তৈরি নিয়মেই যথাযথভাবে অভিব্যক্ত হয়, বাইরের বা জড়জগতের প্রথাবদ্ধ নিয়মে তা স্থবির হয়ে পড়ে। মানসিক যৌবন মানুষের অন্তর্জগতের পরিবর্তন ঘটায় এবং তা অন্যের মনে যেহেতু সঞ্চারিত করা যায় সেহেতু সমাজও যৌবশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে। কিন্তু এই মানসিক যৌবন লাভের জন্যে নিজের আত্মশক্তি বা প্রাণশক্তিতে একনিষ্ঠ থাকা জরুরি। একনিষ্ঠতা দৈবী শক্তির মতো প্রচন্ড ও প্রভাববিস্তারী হলেই মানসিক যৌবন লাভ সম্ভব হতে পারে।

 

যৌবনে দাও রাজটিকা ২

 

রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর লিখুন

১. ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী প্রকৃত যৌবন বলতে কি বুঝিয়েছেন? সমাজে যৌবন রক্ষা করা যায় কিভাবে প্রবন্ধটি অবলম্বনে তা লিখুন।

২. প্রথম চৌধুরী তাঁর ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধে দৈহিক যৌবন নয়, মানসিক যৌবনের কথা বলে সমাজদেহে তা কেন সংক্রমণ করতে চেয়েছেন – – বিস্তৃতভাবে বুঝিয়ে লিখুন।

৩. ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধে সংস্কৃত সাহিত্য সম্পর্কে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা বিবৃত করুন।

৪. “প্রবন্ধ রচনায় প্রমথ চৌধুরী একটি বিশিষ্ট রীতির অনুসারী। ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধেও এর পরিচয় লভ্য।” – বক্তব্যটি প্রতিষ্ঠা করুন।

Leave a Comment