নিরুক্তবিদ্যা, শব্দতত্ত্ব ও অভিধানবিদ্যা

আজকে আমাদের আলোচনার  বিষয়-নিরুক্তবিদ্যা, শব্দতত্ত্ব ও অভিধানবিদ্যা

নিরুক্তবিদ্যা, শব্দতত্ত্ব ও অভিধানবিদ্যা

বাগর্থবিদ্যার মতো নিরুক্তবিদ্যা, শব্দতত্ত্ব ও অভিধানবিদ্যা শব্দের অর্থ নিয়ে কারবার করে। তাই এদের পার্থক্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
নিরুক্তবিদ্যা : নিরুক্তবিদ্যা হচ্ছে শব্দের উৎপত্তি ও বিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনা । শব্দের ইতিহাস অনুসন্ধানই নিরুক্তবিদ্যার কাজ। যেমন আমরা সবাই ছোট ছোট গোটা দৃশ্য বুরিদার সাথে পরিচিত।

কিন্তু এ শব্দটি এলো কোত্থেকে ? নিরুক্তবিদ্যা বলে এটি এসেছে সংস্কৃত বিষ্ণু থেকে । বিন্দু থেকে প্রথমে এসেছে বুন (অর্থ ফোঁটা যেমন আমরা পাই বুদবুদ), বুঁদ থেকে এসেছে বুলিয়া বা বুনী এবং বুলিয়া বা রুদী রূপান্তরের মাধ্যমে প্রথমে বোঁদে পরে বুন্দা এবং সবশেষে হয়েছে বুরিন্দা। বুরিন্দা -র উৎপত্তির ধারাটি নিম্নরূপে দেখানো যान

বিন্দু → → ধুপিয়া / ধুপী ধাপে বুদা → বুরিন্দা

কখন ও কিভাবে একটি শব্দের সৃষ্টি হয়েছে এবং সৃষ্টির পর থেকে শব্দটির ভাগ্যে কি ঘটেছে নিরুক্তবিদ্যা তা উদ্ঘাটনে প্রয়াসী হয়। অন্য কথায়, তার কাজ শব্দের ব্যুৎপত্তির ঠিকুজি রচনা করা। প্রাচীন ভারতের ভাষাবিজ্ঞানীরা নিরুক্তবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন।

 

নিরুক্তবিদ্যা, শব্দতত্ত্ব ও অভিধানবিদ্যা

 

খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে বেদের বাণী বিশ্লেষণে যাঙ্ক লিখেছিলেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ নিরুক্ত যা বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার জন্য আরও প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বৈয়াকরণদের

প্রশংসা কুড়ায় (Lepschy 1994:31 Varshney 1993 386 ) ।

অভিধানবিদ্যা : অভিধানবিদ্যা হচ্ছে শব্দ সংগ্রহ, বিন্যাস ও তাদের অর্থ বর্ণনার কাজ। হাওয়ার্ড জ্যাকসন
(১৯৮৮: ২৩৯-২৫০) লক্ষ্য করেন যে অভিধানবিদ্যা তিনটি অর্থে ব্যবহ্যত হতে পারে : প্রথমত, এটি অভিধান সংকলনের মূলনীতিসমূহ বোঝাতে পারে দ্বিতীয়ত, এটি অভিধান সংকলনের প্রক্রিয়াকে বোঝাতে পারে ।

তৃতীয়ত, এটি অভিধান সংকলনের পেশাকে বোঝাতে পারে । আমাদের কাছে তৃতীয়টির চেয়ে প্রথম ও দ্বিতীয়াটির আবেদন বেশি। অভিধান সংকলনের কতগুলি ধাপ রয়েছে, যেমন প্রথমে ভাষার নমুনা সংগ্রহ করতে হয়, তারপর সেখান থেকে শব্দ বাছাই করতে হয়, শব্দগুলোকে অক্ষরক্রমে সাজাতে হয় এবং সবশেষে তাদের উচ্চারণ ও অর্থ লিপিবদ্ধ করতে হয় ।

 

নিরুক্তবিদ্যা, শব্দতত্ত্ব ও অভিধানবিদ্যা

 

নিরুক্ত-বিদ্যা যেখানে শব্দের বুৎপত্তি নির্ণয়া করে, অভিধানবিদ্যা সেখানে শব্দের অর্থের বিবর্তন অনুসন্ধান করে। অভিধানবিদ্যা দেখায় ঐতিহাসিকভাবে একটি শব্দের অর্থের কিরূপ পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন ইংরেজী gig শব্দটির কথা ধরা যাক। ঐতিহাসিকভাবে এটি অন্ততঃ সতেরোবার অর্থ পরিবর্তন করেছে (Billard and Jenkinson 1967 69 70 ) The Oxford English Dictionary বিভিন্ন সময়ে শব্দটির অর্থের পরিবর্তন নথিভুক্ত করেছে । পরিবর্তনের ধারাটি সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

মধ্যযুগীয় ইংরেজী- – ঘোরে এমন কিছু
5541 – চাবুক ঘোরানো

এদিক ওদিক না

১৭২২ – মাছ মারার টেটাবিশেষ

১৭৭৭- অদ্ভূত ব্যাপার

১৭৭৭ আনন্দ বা উল্লাস

১৭৮০ – চপলা মেয়ে

১৭৮৮৯ – কাপড়কে নরম ও পশমী বানানো

1920 হালকা চ্যাপটা নৌকাবিশেষ

১৭৯১ – এক ঘোড়ায় টানা হালকা দুই চাকার গাড়ি

3609- উক্ত গাড়িতে ভ্রমন করা

১৮১৬ – টেটাজাতীয় বস্তু দিয়ে মাছ শিকার করা

১৮২১ – মজা বা কৌতুক

১৮৬৫ – এক ধরনের বাইচের নৌকা ১৮৭৫ – সামনে বা পিছনে যাওয়া

১৮৮১ – খনিতে কাজ করার কাঠের বারাবিশেষ

১৯০০ – বিদ্যালয়ে বা সেনাবাহিনীতে নিয়মের সামান্য

বর্তমান – আধুনিক জনপ্রিয় গানের গায়ক বা গায়কদল বা তাদের পরিবেশনা

অভিধান সংকলন নিঃসন্দেহে একটি আয়াসসাধ্য শিল্পকর্ম। স্যামুয়েল জনসন (Dictionary of the English Language). এ এইচ মুরে (Oxford English Dictoinary), টম ম্যাকআর্থার (Longman Lexicon of Contemporary English), প্যাট্রিক হ্যাঙ্কস (Collins English Dictionary), নোয়া ওয়েস্টার ( Webter’s Dictionary) প্রমুখ পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ অভিধান সংকলক হিসাবে অমর হয়ে আছেন ।

বাংলা ভাষার ভূখন্ডে রাজশেখর বসু শৈলেন্দ্র বিশ্বাস, আশুতোষ নের প্রমুখ অভিধান সংকলন করে খ্যাতিমান হয়েছেন ।

 

নিরুক্তবিদ্যা, শব্দতত্ত্ব ও অভিধানবিদ্যা

 

শব্দতত্ত্ব : শব্দতত্ত্ব হচ্ছে শব্দের অর্থ ও ব্যবহার সংক্রান্ত আলোচনা। শব্দতত্ত্ব কি বাগর্থবিদ্যার শাখা নাকি বাগর্থবিদ্যা শব্দতত্ত্বের শাখা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। স্টিফেন উপম্যান (১৯৫৭) মনে করেন বাগর্থবিদ্যা শব্দতত্ত্বের অংশ। তিনি বলেন যে শব্দতত্ত্ব অর্থপূর্ণ একক তথা শব্দ ও শব্দগঠনকারী রূপমূল নিয়ে কারবার করে, ফলতঃ শব্দতত্ত্ব দুটি মৌলিক বিভাগ রূপতত্ত্ব ও অর্থতত্ত্বে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

কাজেই দেখা যায় উলম্যান এভাবে বাগর্থবিদ্যার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করেছেন একে করে তুলেছেন শব্দতত্ত্বের অধীনস্থ । তদুপরি তিনি নিরুক্ত-বিদ্যাকেও অভিধানতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেছেন। উইটোন্ড ভরোসলেউইস্কি শব্দতত্ত্বের সংজ্ঞা দিতে গেয়ে বলেছেন, শব্দতত্ত্ব হলো শব্দের অর্থ ও ব্যবহারের আলোচনা, শব্দভান্ডারের বিজ্ঞান ও অভিধান সংকলনের তাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক ভিত্তি (Howard Jackson 1988: 241)। শব্দতত্ত্বকে অভিধান সংকলনের ভিত্তি বলা হয়েছে কারণ শব্দতাত্ত্বিক সূত্র সমূহের প্রয়োগ হয় অভিধান প্রণয়ন ও সম্পাদনায় ।

আরও দেখুন:

 

Leave a Comment