সংস্কৃতি কথা । বাংলা ভাষা ১ সাহিত্য

মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধটিতে প্রবন্ধকারের সংস্কৃতি সম্বন্ধীয় চিন্তা-ভাবনা যুক্তি ও তর্কের ভেতর দিয়ে মুক্তবুদ্ধির আলোকে প্রকাশিত। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় ‘সাহিত্য-সমাজ’ নামে যে প্রতিষ্ঠানটি ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলো মোতাহের হোসেন চৌধুরী ছিলেন তার সঙ্গে সংশিষ্ট। তাঁর সংস্কৃতি চিন্তার মূলেও রয়েছে মূলত মুক্তবুদ্ধির আহ্বান। জ্ঞানের আড়ষ্টতা ও বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা থেকে বৌদ্ধিকমুক্তির প্রত্যাশা ব্যক্ত মোতাহের হোসেন চৌধুরীর প্রবন্ধে ।

সংস্কৃতি কথা

 

সংস্কৃতি কথা ১

 

লেখক পরিচিতি

মোতাহের হোসেন চৌধুরী ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ এবং ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিলো নোয়াখালি জেলার কাঞ্চনপুর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে এম.এ. পাশ করে অধ্যাপনায় যোগ দেন। তিনি ছিলেন সুরুচিসম্পন্ন, সংস্কৃতিবান, উদার, যুক্তিবাদী মানুষ।

ঢাকার ‘সাহিত্য-সমাজ’ (১৯২৬) প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ছিলো তাঁর গভীর যোগাযোগ। তিনি মূলত প্রাবন্ধিক হিসেবেই খ্যাত। প্রথম জীবনে কবিতা লেখার কারণে বন্ধু ও পরিচিতমহলে ‘কবি’ হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিলো। পরবর্তীকালে কবিতা লেখা ত্যাগ করে বাংলা ভাষায় যুক্তিশিষ্ঠ ও মুক্তবুদ্ধি-দীপ্ত প্রবন্ধ রচনায় তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর গদ্যে একটি বিশিষ্টতা আছে। সরল ও আকর্ষণীয় গতিশীল গদ্য তিনি রচনা করেছেন।

কৃত্রিম আড়ষ্টতা নয়, বরং অনুপলব্ধ চিন্তাকে রসসমৃদ্ধ করে পরিবেশনের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। শিল্পীর একাগ্রতা ও অধ্যবসায়ে তিনি তাঁর ভাষা ও রচনাশৈলী গড়ে তুলেছেন। জীবনদর্শনে তিনি ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০) ও ক্লাইভ বেল (১৮৮১-১৯৬৪)- এর ভাবানুসারী। স্বাধীন ও মুক্ত ব্যক্তিত্বের বিকাশ তাঁর অন্বিষ্ট ছিলো, কিন্তু তা তিনি করতে চেয়েছেন সামাজিক অনুষঙ্গকে সংস্কারের মাধ্যমে।

বুদ্ধির মুক্তির পথ ধরে তিনি যাত্রা করলেও হৃদয়ধর্মকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সংস্কৃতি-সাধনার গভীরে এ বোধই কার্যকর। জীবদ্দশায় তাঁর কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। মৃত্যুর পর ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর একমাত্র বাংলা প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রকাশিত হয়। এছাড়া প্রকাশ পায় ক্লাইভ বেলের Civilization -এর অনুবাদ ‘সভ্যতা’ (১৯৬৫) ও ‘Conquest of Happiness’-এর অনুবাদ ‘সুখ’ (১৯৬৮)।

পাঠ-পরিচিতি

মোতাহের হোসেন চৌধুরীর একমাত্র প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সংস্কৃতি-কথা’ (১৯৫৮) থেকে ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে প্রবন্ধকারের সংস্কৃতি সম্বন্ধীয় ভাবনা যৌক্তিক যুক্তির পারম্পর্যে ও তর্কের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত। মুক্তবুদ্ধির যে আন্দোলন তাঁরা শুরু করেছিলেন, এ প্রবন্ধেও তার প্রভাব কার্যকর। বিষয় ও শিল্পরীতিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সাহিত্য শিল্পের নামকরণ করা হয়ে থাকে।

বর্তমান প্রবন্ধের নামকরণের ক্ষেত্রে সে দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়েছে। কারণ এখানে সংস্কৃতির মৌল উপাদান চিহ্নিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে মানব জীবনে এর প্রভাব বিস্তার সম্পর্কে উল্লেখ আছে। প্রবন্ধটির মূল বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেই এর নামকরণ যথার্থ হয়েছে কিনা তা বুঝা যাবে। ‘সংস্কৃতি’ অভিধাটি বিশাল ও বহুমাত্রিক। এর সংজ্ঞা ও স্বরূপ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কম হয়নি। বহু মণীষী এ নিয়ে গভীর ও পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন।

মোতাহের হোসেন চৌধুরীও এ প্রসঙ্গে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছেন বর্তমান প্রবন্ধে। তিনি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীচেতনা, মতবাদ-অন্ধত্ব ও ধর্মীয় অনুভূতির গন্ডিবদ্ধতা শনাক্ত করে সংস্কৃতির যথার্থ পরিচয় তুলে ধরেছেন। প্রবন্ধের প্রথম বাক্যটিতেই যেন প্রথাবিরোধী বিদ্রোহী এক বক্তব্য তিনি প্রদান করেন, ‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম।’ আসলে সংস্কৃতি হলো প্রেম, সৌন্দর্য ও মার্জিত জীবনবোধের পরিশীলিত সমন্বয়।

মানুষের আত্মিক প্রশান্তির মূলে রয়েছে তার সুস্থ সংস্কৃতিচেতনা। অন্যায় ও কলুষতার সঙ্গে সংস্কৃতিবান মানুষ সহবাস করতে পারে না। মুক্ত বুদ্ধি, উদার মানবতাবোধ, মার্জিত শিক্ষা ও পরিশীলিত জীবনচর্চা যেখানে নিঃসংশয়ভাবে প্রকাশিত সেখানেই প্রকৃত সংস্কৃতির প্রজ্বলন। সাধারণ মানুষ এর সমন্বয় সহজে করতে পারে না। তাই ধর্মই হয়ে ওঠে তাদের কালচার। তারা ধর্মের পথে বিচরণ করে সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠে।

তবে ধর্ম পরমত সহিষ্ণু নয়, যেমন নয় কোন মতবাদ। মতবাদিগণ অন্যের মতকে সহ্য বা স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু সংস্কৃতি তা নয়। সংস্কৃতি হলো সত্য, সুন্দর আর আনন্দের পথে ধাবমানতা অন্যের মত ও পথকে অবহেলা না করেই এই অকৃত্রিম অনুভব লাভ করেন সংস্কৃতিবান মানুষ। কল্যাণ ও সাম্যকে সংস্কৃতি স্বীকার করে, সেই সঙ্গে চিন্তার স্বাতন্ত্র্যকেও গুরুত্ব দেয়।

কৃপএভুকতা থেকে মুক্তি দিয়ে সংস্কৃতি মানুষকে উদার, সহনশীল, ও মানবতাবাদী করে তোলে। সে পৃথিবীতে স্বর্গীয় সুখ ও আনন্দ লাভ করতে প্রয়াসী হয় বলেই পারলৌকিক স্বর্গে তার আস্থা কমে আসে। সব মানুষের মধ্যে আত্মিক বন্ধন অন্বেষাই একজন সংস্কৃতিবান মানুষের কাছে প্রধান হয়ে ওঠে।

মূলপাঠ

ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা – সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি। সাধারণ লোকেরা ধর্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে। তাই তাদের ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কালচার থেকে বঞ্চিত করা এক কথা। ধর্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ। মার্জিত আলোকপ্রাপ্তরা কাচারের মারফতেই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত করে।

বাইরের আদেশ নয়, ভেতরের সূক্ষ্মচেতনাই তাদের চালক, তাই তাদের জন্য ধর্মের ততটা দরকার হয় না। বরং তাদের উপর ধর্ম তথা বাইরের নীতি চাপাতে গেলে ক্ষতি হয়। কেননা তাতে তাদের সূক্ষ্ম চেতনাটি নষ্ট হয়ে যায়, আর সূক্ষ্মচেতনার অপর নাম আত্মা । সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কাচারের উদ্দেশ্য নয় – – উপায়। উদ্দেশ্য, নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আলাহ সৃষ্টি করা।

যে তা করতে পেরেছে সে-ই কালচার্ড অভিধা পেতে পারে, অপরে নয়। বাইরের ধর্মকে যারা গ্রহণ করে তারা আলাকে জীবনপ্রেরণা রূপে পায় না, ঠোঁটের বুলি রূপে পায়।

তাই শ’র উক্তি: Beware of the man whose God is in the skies – আলা যার আকাশে তার সম্বন্ধে সাবধান। কেন না, তারারা যে কোন অন্যায় ও নিষ্ঠুর কাজ হতে পারে। আলাকে সে স্মরণ করে ইহলোকে মজাসে জীবন যাপন করবার জন্য আর পরকালে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে, অথবা স্বর্গে একটা প্রথম শ্রেণীর সিট্ রিজার্ভ করার আগ্রহে অন্য কোন মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ইহকালে ও পরকালে সর্বত্রই একটা ইতর লোভ ।

অপর দিকে কাল্‌চার্ড লোকেরা সব চেয়ে বেশী ঘৃণা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে; অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। মানুষকে ন্যায়সঙ্গত ভাবে শাস্তি দিতেও তাদের বুক কাঁপে। নিষ্ঠুর হয়ো না – এই তাদের ভেতরের দেবতার হুকুম আর সে হুকুম তারা তামিল না করে পারে না, কেন না নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই একটা ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন বা স্বধর্ম সৃষ্টি করা কাচারের উদ্দেশ্য।

যেখানে তা নেই সেখানে আর যাই থাক্ কাচার নেই । কাচার একটা ব্যক্তিগত ধর্ম। ব্যক্তির ভেতরের ‘আমি’কে সুন্দর করে তোলাই তার কাজ। কাচার সমাজতান্ত্রিক নয়, ব্যক্তিতান্ত্রিক। নিজেকে বাঁচাও, নিজেকে মহান করো, সুন্দর করো, বিচিত্র করো এ-ই কাচারের আদেশ। এবং এই আদেশের সফলতার দিকে নজর রেখেই তা সমাজতন্ত্রের সমর্থক। সমাজতন্ত্র তার কাছে লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ।

কাচার ব্যক্তিতান্ত্রিক এ কথা বললে এ বুঝায় না যে, কালচার্ড মানুষ সমাজের ধার ধারে না, সে দলছাড়া, গোত্রছাড়া জীব। তা নয়, সমাজের ধার সে খুবই ধারে।

নইলে প্রাণ পাবে কোত্থেকে? ব্যক্তি তো নদী, সমাজ সমুদ্র। সমুদ্রের সঙ্গে যোগ-যুক্ত না হলে সে বাঁচবে কী উপায়ে? সুতরাং নিজের স্বার্থের দিকে নজর রেখেই কালচার্ড মানুষ সমাজের কথা ভাবে, এমন কি দরকার হলে সমাজের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত থাকে। সংস্কৃতিবান মানুষ ব্যক্তিতান্ত্রিক এই অর্থে যে, সমাজ বা অর্থনীতির কথা ভেবে সে নিজের অসৌন্দর্যকে ক্ষমা করে না।

এই সমাজে, এই অর্থনীতির অধীনে এর চেয়ে বেশী সুন্দর হওয়া যায় না, এ কথা বলে নিজেকে কি অপরকে সান্ত্বনা দিতে সে লজ্জাবোধ করে। সে চায় নিজের সৌন্দর্যবোধের সম্পূর্ণ উন্মোচন, নিজের প্রতিভার সম্পূর্ণ বিকাশ। নিজের কাছ থেকে ষোল আনা আদায় করে না নিতে পারলে সে খুশী হয় না। এই জন্য শুধু সমাজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা তার মনঃপূত নয়।

কেননা তাতে জীবনের গভীরতর স্তরের ধ্যানকল্পনার সম্পূর্ণ প্রকাশ ব্যাহত হয়, এবং নিভৃতবাসী অন্তর-পুরুষের সাক্ষাৎকার সম্ভব হয় না। জীবনের শ্রেষ্ঠ ও বহুভঙ্গিম প্রকাশ নিজের দিকে তাকিয়েই হয়, সমাজের দিকে তাকিয়ে নয়। অত্যধিক সমাজচেতনা মানুষকে একপেশে ও প্রমাণ সাইজ করে রাখে। মানুষের চূড়ান্ত বৃদ্ধিতে অন্তরায় ঘটায়। সমাজের আদেশ: দশের মধ্যে এক হও, এগারো হয়ো না।

এগারোদের সে সহ্য করে না – – যদিও গৌরবের জন্য মাঝে মাঝে মাথায় করে নাচে। কাচারের আদেশ: দশের মধ্যে এগারো হও, দশের মধ্যে থেকেই নিজেকে নিজের মতো করে, সর্বাঙ্গ সুন্দর করে ফুটিয়ে তোল। তাতেই হবে তোমারমারা সমাজের শ্রেষ্ঠ সেবা, যদিও সমাজের বিরক্তি-ভাজন হওয়াই হবে তোমার ভাগ্য। সমাজ সাধারণভাবে মানুষকে সৃষ্টি করে, মানুষ আবার নিজেকে গড়ে তোলে শিক্ষাদীক্ষা ও সৌন্দর্যসাধনার সহায়তায়।

এই যে নিজেকে বিশেষভাবে গড়ে তোলা এরি নাম কাচার। তাই কালচার্ড মানুষ স্বতন্ত্র-সত্তা, আলাদা মানুষ। নিজের চিন্তা, নিজের ভাবনা, নিজের কল্পনার বিকাশ না হলে কালচার্ড হওয়া যায় না। চিন্তা বা বিশ্বাসের ব্যাপারে সমতা স্থাপন করে মানুষের স্বাতন্ত্র্য্য লুপ্ত করতে চায় বলে ধর্ম অনেক সময়ে কালচারের পরিপন্থী। মতবাদীও এ দোষে দোষী, তাই মতবাদী ও ধার্মিকের মধ্যে একটা সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। উভয়েই সরকারী গলায় কথা বলে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যের উপরে ষ্টীমরোলার চালাতে ভালোবাসে।

 

সংস্কৃতি কথা ১

 

শব্দার্থ ও টীকা

কালচার – ইংরেজি শব্দ (Culture)। বাংলা অর্থ ‘সংস্কৃতি’ বা ‘কৃষ্টি’। জীবনে চর্চিত অনুশীলনলব্ধ রীতি-নীতি বা আচার-আচরণ এবং বিদ্যাবুদ্ধি। উন্নত রুচিবোধ, শিল্পস্পৃহা, মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ এই কালচারের অঙ্গীভূত।

মার্জিত আলোকপ্রাপ্তরা – সুশিক্ষার ফলে উৎকর্ষপ্রাপ্ত বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কাচারের উদ্দেশ্য নয়, উপায় – ‘উদ্দেশ্য’ শব্দের অর্থ ‘লক্ষ্য’ বা ‘অভিপ্রেত’ বা ‘উদ্দেশ করা হয় এমন কিছু। আর ‘উপায়’ শব্দের অর্থ ‘অভীষ্টলাভের বা কার্যসাধনের পন্থা বা প্রণালী’। এখানে বলা হয়েছে যে, সাহিত্য, শিল্প বা সঙ্গীত চর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ যাপিত জীবনে প্রকৃত সংস্কৃতিমান হয়ে ওঠে। এর অর্থ এই নয় যে, সাহিত্য বা সঙ্গীতচর্চা মানেই সংস্কৃতি

কালচার্ড – অর্থাৎ সংস্কৃতিমান। সংস্কৃতিতে যিনি একাত্ম হয়েছেন।

অভিধা- নাম, সংজ্ঞা, উপাধি । স্বর্গে একটি প্রথম শ্রেণীর সিট্ রিজার্ভ করা • পরকালে প্রশান্তিতে থাকার নিশ্চয়তা। ধর্ম বিশ্বাসীগণ মৃত্যুর পর সুখে শান্তিতে থাকতে চান। এখানে প্রবন্ধকার ‘সিট্ রিজার্ভ’ কথাটি ব্যঙ্গাত্মকভাবে ব্যবহার করেছেন। অনেকে মনে করেন যে, শুধু সৃষ্টিকর্তার প্রার্থনার মধ্যেই ইহজাগতিক সুখভোগ ও পারলৌকিক প্রশান্তি প্রাপ্তি সম্ভব। পরলোকে নিজের জন্যে একটি সর্বসুখপ্রদায়ী চিরস্থায়ী আসন নিশ্চিত করতে তাদের এ ধরনের প্রার্থনায় অবতীর্ণ হওয়ার মধ্যে মহত্ত্বের চেয়ে স্বার্থসিদ্ধির মনোবাসনাই লেখক আবিষ্কার করেছেন।

ইতর লোভ — ‘লোভ’ একটি খারাপ প্রবৃত্তি। ‘ইতর’ বিশেষণ ব্যবহার করে এই প্রবৃত্তির নেতিবাচকতা অধিকতর সুস্পষ্ট করা হয়েছে। নীচ বিষয়তৃষ্ণা বা সব কিছু আত্মসাৎ করার প্রবৃত্তি ।

ন্যায় নিষ্ঠুরতা – ‘নিষ্ঠুরতা’ অর্থ ‘নির্দয়তা’। ন্যায়ভাবেও এই নির্দয়তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। যেমন, হত্যাকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড। — এখানে মৃত্যুদন্ড কার্যকর সামাজিকভাবে ন্যায়পথে নিষ্ঠুরতা প্রকাশ।

তামিল – পালন। ব্যক্তিগত ধৰ্ম – একান্ত নিজের জীবন-দর্শন ।

সমাজতান্ত্রিক – একটি রাজনৈতিক মতবাদ। এই মতবাদ অনুসারে রাষ্ট্রের সমস্ত সম্পদের মালিক জনগণ।

কিন্তু প্রবন্ধে – ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটির ব্যবহার ‘সমাজ ভিত্তিক’ বা ‘সমাজ নির্ভর’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

ব্যক্তিতান্ত্রিক — এই শব্দটিও ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য্য’ অর্থে ব্যবহৃত; কোন মতবাদ প্রকাশক নয়।

দশের মধ্যে এক হওয়া – গতানুগতিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা। যা প্রচলিত ও বহুকাল ধরে চর্চিত তার বাইরে না যাওয়া। স্বতন্ত্র-সত্তা – অন্যদের থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া।

মনের জগতে লেফট্-রাইট্ — তত্ত্ব বা কতিপয় নিয়মের অনুসারী হয়ে মনের জগতকে সুনির্দিষ্ট ও গন্ডিবদ্ধ করে ফেলা।

বস্তু-সংক্ষেপ

শিক্ষিত ও মার্জিতরুচির ব্যক্তির সঙ্গে সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার প্রধান পার্থক্য হলো, কালচার যেখানে শিক্ষিত লোকের ধর্ম, সেখানে ধর্মই সাধারণ মানুষের কালচার। শিক্ষিত ব্যক্তি সৌন্দর্য, প্রেম, জ্ঞান ইত্যাদির সাধনা করে। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীতের মতো উপায়ের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে কালচার্ড করে তোলে। কালচার্ড ব্যক্তি আত্মার আনন্দের লক্ষ্যে মানুষ্যত্ব ও মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়।

কিন্তু ধার্মিক ব্যক্তি পরলোকে সুখ সুনিশ্চিত করতে অথবা শাস্তির ভয়ে ধর্ম চর্চা করেন। কালচার্ড ব্যক্তির কাছে নিষ্ঠুরতা মাত্রই পরিত্যাজ্য, এবং তা যদি ন্যায় নিষ্ঠুরতা হয়, তবুও। কালচার বা সংস্কৃতির মূল কথাই হচ্ছে ব্যক্তিসত্তার বিকাশ। এই বিকাশটি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে প্রকাশিত হয়। সমাজের অন্যদের সঙ্গে এর সম্পর্ক সামান্যই। কেননা, কালচারের মূল বৈশিষ্ট্য সৌন্দর্যবোধ, প্রেম, সত্য, মহত্ত্ববোধ ইত্যাদি ব্যক্তিভেদে পার্থক্য হতে বাধ্য।

কালচার্ড বা সংস্কৃতিমান মানুষ সমাজের প্রথাবদ্ধতা অতিক্রম করতে প্রয়াসী হন; কিন্তু সমাজ তাকে পারিপার্শ্বের আর দশজনের মধ্যেই আটকে রাখতে চায়। ধার্মিকেরা সমাজের প্রচলিত বিধিবদ্ধতা আরও কঠিন করতে চান। কোন নির্দিষ্ট মতবাদের অনুসারীরাও ধার্মিকদের মতোই নির্দিষ্টতায় আবর্তিত হয়। ধর্ম ও মতবাদ মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, কিন্তু কালচার তা করে না।

কালচার বা সংস্কৃতি মানুষকে নিজের মতো মুক্ত চিন্তা করতে অনুপ্রেরণা ও স্বাধীনতা দেয়। ধর্ম মানুষকে স্বর্গের লোভ ও নরকের ভয় দেখিয়ে নির্দিষ্ট পথে রাখতে চায়। কিন্তু সংস্কৃতি বা কালচার কোন ভয় বা লোভ দেখায় না, মনুষ্যত্ব বিকাশ ও আনন্দ এর একমাত্র লক্ষ্য।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের উত্তর লিখুন

১. ‘সংস্কৃতি’ কি?

২. ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির পার্থক্য কোথায়?

৩. স্বর্গে একটি প্রথম শ্রেণীর সিট্ রিজার্ভ করা’ – বলতে প্রবন্ধকার কি বুঝিয়েছেন?

৪. ধার্মিক ও মতবাদীদের সঙ্গে সংস্কৃতিবান মানুষের পার্থক্য কোথায়?

৪ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-উত্তর

ধর্ম যেমন মানুষকে কতিপয় নিয়ম ও প্রথায় আবদ্ধ করে ফেলে, তেমনি মতবাদও মানুষের জন্যে নির্দিষ্ট গন্ডি বেঁধে দেয়। ধার্মিক ও মতবাদীরা নিজেদের অনুসৃত পথ ছাড়া অন্য সবকিছুকে ভ্রান্ত মনে করে। এ কারণে নিজের সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী ছাড়া অন্যদের উপর তারা অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। ধার্মিক এই নিষ্ঠুরতা করে ধর্মগ্রন্থের সমর্থনে, আর মতবাদীরা সাহায্য নেয় বিজ্ঞানের।

কিন্তু সংস্কৃতি পরের মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শেখায়। সংস্কৃতিতে যেহেতু জ্ঞানেন্দ্রিয়ের চর্চা হয় বেশি, সেহেতু সংস্কৃতিবান মানুষ সত্যদর্শন ও যৌক্তিক যুক্তির পারম্পর্যে প্রেমময় দৃষ্টিতে বিচার করে সব কিছু। তার কাছে অন্যায় নিষ্ঠুরতার মতো ন্যায় নিষ্ঠুরতাও অবশ্য পরিত্যাজ্য। ধার্মিক ও মতবাদীরা যেখানে বাইরে থেকে বেঁধে দেয়া দর্শন গ্রহণ করে, সংস্কৃতিবান সেখানে বহু নিষ্ঠায় নিজের ভেতর থেকে একটা জীবনদর্শনের জন্ম দেয়- মূল পার্থক্য। এখানেই হচ্ছে

প্রসঙ্গ উলেখ করে ব্যাখ্যা লিখুন

১. ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম।

২. সাহিত্য শিল্প সঙ্গীত কালচারের উদ্দেশ্য নয় উপায়। উদ্দেশ্য, নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আলাহ্ সৃষ্টি করা।

৩. মতবাদীও এ দোষে দোষী, তাই মতবাদী ও ধার্মিকের মধ্যে একটা সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।

৪. গোলাপের সঙ্গে যদি দুএকটা কাঁটা এসেই যায়, তো আসুক না, তাতে ক্ষতি নেই, দেখতে হবে শুধু ফুল ফুটল কিনা -এ-ই কালচারের অভিমত।

 

সংস্কৃতি কথা ১

 

২ নং ব্যাখ্যার নমুনা-উত্তর:

ব্যাখ্যেয় অংশটুকু বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মোতাহের হোসেন চৌধুরী রচিত ‘সংস্কৃতি-কথা’ নামক প্রবন্ধ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে সংস্কৃতির সঙ্গে সাহিত্য, শিল্প ও সঙ্গীতের আন্তঃসম্পর্ক কীভাবে ও কতটুকু সে সম্পর্কে প্রবন্ধকার মন্তব্য করেছেন।
কালচার বা সংস্কৃতি একটি অধরা প্রতীতি, যা অর্জন করতে হয়। সংস্কৃতি মানুষের রুচি উন্নত করে, বিবেককে করে জাগ্রত।

এই উন্নত রুচি ও জাগ্রত বিবেকেরপারা মানুষ সত্য, ন্যায়, জ্ঞান, প্রেম ও দয়াকে বরণ করে আর মিথ্যা অন্যায়, অজ্ঞান ও হিংসাকে ঘৃণা করে। এতে মানুষের নিজের ভেতরে একটি নৈতিক অবস্থান সৃষ্টি হয় – — যারারা সে নিজে পরিচালিত হতে পারে। এটাই ঈশ্বর বা আলাহ্’র সৃষ্টি। এই ঈশ্বর বা আলাহ কোন আরোপিত বহিঃশক্তির প্রতিক্রিয়া নয়।

সাহিত্য, শিল্প বা সঙ্গীত সাধনার মাধ্যমেও মানুষ রুচিকে উন্নত করতে পারে, জন্ম দিতে পারে নিজের মধ্যে দায় ও নীতিবোধের। তাই বলে কোন গ্রন্থের প্রণেতা কিংবা সঙ্গীতশিল্পীমাত্রই সংস্কৃতিবান মানুষ এমন নাও হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, সংস্কৃতি হলো একটি মানবিক পরিবর্তন ; যা মানুষকে সুশীল ও উন্নততর জীবন গড়ার ইঙ্গিত দেয়। সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত মানুষকে এ-পথে এগিয়ে যেতে সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে।

 

 

 

সংস্কৃতি কথা ২

মূলপাঠ

বিকাশকে বড় করে দেখেনা বলে ধর্ম সাধারণতঃ ইন্দ্রিয় সাধনার পরিপন্থী। অথচ ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে জীবনসাধনারই অপর নাম কাচার। মন ও আত্মার সঙ্গে যোগযুক্ত করে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বকের নবজন্মদানই কাচারের উদ্দেশ্য। অবশ্য এই ইন্দ্রিয়নিচয়ের সবকটিই যে সমমূল্য তা নয়। ইন্দ্রিয়গুলির মধ্যে চক্ষু আর কানই সেরা। তাই তাদের স্থান সকলের আগে দেওয়া হয়েছে। চোখের মানে ছবির সাধনা, কানের সাধনা গানের।

(সাহিত্যের মধ্যে চোখ ও কান উভয়েরই কাজ রয়েছে, কেননা তা ছন্দ ও ছবি উভয়ের মিলন।) চোখ ও কানের পরেই নাসিকার স্থান- – নিঃশ্বাস গ্রহণের সহায়তায় বাঁচবার সুযোগ দেয় বলে নয়, সুগন্ধ উপলব্ধিরারা আত্মাকে প্রফুল রাখবার সুযোগ দেয় বলে। চোখ ও কান ‘আত্মার’ জিহ্বা, এদের মারফতেই সে তার খাদ্য চয়ন করে। অথচ, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, কোন কোন ধর্ম এই চোখ ও কানের সাধনারই পরিপন্থী, সেখানে তারা পতনের ফাঁদ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না।

তাই আমরা চোখ থাকতেও কানা, কান থাকতেও কালা। সুর বা ছবির সূক্ষ্মতা আমাদের প্রাণে দাগ কাটে না । চোখ ও কানের প্রতি বেখেয়াল থাকা যে আত্মার প্রতিই বেখেয়াল থাকা, সংস্কৃতিবানরা তা বুঝলেও ধার্মিকের মাথায় তা সহজে ঢোকে না। তাই তারা শুধু ঈশ্বরের নাম নেয়, ঐশ্বর্য উপলব্ধি করে না। ইন্দ্রিয়ের সাধনা বলে কাচারের কেন্দ্র নারী। নারীর চোখ মুখ, স্নেহ-প্রীতি, শ্রী ও হ্রী নিয়েই কাচারের বাহন শিল্প- সাহিত্যের কারবার।

ইন্দ্রিয়গ্রামের জাগরণ ও নিয়ন্ত্রণের মূলেও নারী। ‘বোধকলি’ তার প্রসাদেই ফোটে, জীবনের শক্তি, সাহস ও সাধনার প্রেরণা নারী থেকেই আসে। তাই কবির মুখে শুনতে পাওয়া যায়, ‘আমি হব না তাপস, হব না, হব না, যদি না পাই তপস্বিনী’ জীবনে তপস্যা করতে চায় বলে নারী-সঙ্গ কালচার্ড মানুষের এতো কাম্য। বৈরাগীরা নারীকে পর করে সংস্কৃতিকেও পর করে। তাই তাদের জীবনে বৃদ্ধি নেই, তারা নিঃস্ব – নব-নব বুদ্ধি ও প্রীতির স্বাদ থেকে বঞ্চিত।

কী মানসিক, কী সাংসারিক সর্বপ্রকার সমৃদ্ধির গোড়ায় নারী। যাত্রাপথে নারীর জয়ধ্বনিই পুরুষের জীবন-পথের শ্রেষ্ঠ পাথেয়। যে জাতি নারীকে সম্পূর্ণ রূপে আলাদা রাখতে চায় সে জাতি জীবনে মৃত্যুর আরাধনা করে – ইতিহাসের খাতায় সে মরা-জাতির পৃষ্ঠায় নাম লেখায়। তার জীবনে আত্ম-নির্যাতন আছে, আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই। আর আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই বলে সংস্কৃতিও নেই। কেন না সংস্কৃতি মানেই আত্মনিয়ন্ত্রণ – নিজের আইনে নিজেকে বাঁধা ।

ধর্মের মধ্যে বৈরাগ্যের বীজ উপ্ত রয়েছে। কোন কোন ধর্ম নারীকে দেখেছে বিষের নজরে, আর কোন কোন ধর্ম ততটা না গেলেও সঙ্গীত-নৃত্যের মারফতে নারীকে ঘিরে যে ইন্দ্রজাল সৃষ্টি তাতে জানিয়েছে ঘোর আপত্তি। সঙ্গীত-নৃত্য ইত্যাদি তার কাছে কামেরই আয়োজন, কামের উন্নয়ন নয়। ফলে সূক্ষ্ম উপভোগের সহায় না হয়ে নারী স্থুল ভোগের বস্তু হয়েই রইল, নব নব উন্মেষশালিনী বুদ্ধির প্রেরক ও উচ্চতর জীবনের সহায় হতে আর পারলে না।

যৌন ব্যাপারে বিশেষ ও কড়া শাসনের ফলে মানুষ তাতেই আকৃষ্ট হয়ে রইল- যৌন সম্ভোগকে অতিক্রম করে যে প্রেম ও আনন্দ তা অনুভব করতে পারলে না বলে। নিষিদ্ধ বস্তু সাধারণত: ভীতি ও অতিরিক্ত আকর্ষণ – এই দুই মনোবৃত্তির সংঘর্ষ বাধিয়ে জীবনে বিকৃতি ঘটায়। এখানেও তাই হল, যৌন ব্যাপারে মন্দ, একথা না বলে যদি বলা হত প্রেম ভালো, আনন্দ ভালো, প্রেমের জন্য প্রতীক্ষা ভালো, আনন্দের জন্য প্রতীক্ষা ভালো, তা হলে পৃথিবীর চেহারা হয়তো এতো কদর্য হত না।

প্রেমেরসারা কাম নিয়ন্ত্রিত হ’ত বলে ব্যভিচার ও বিরোধ উভয়ের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ সহজ ও সুন্দর হতে পারত। কিন্তু তা না বলে নীতিবিদরা মানুষকে সংযম শিক্ষা করতে বললেন, অথচ কোন্ বড় জিনিসের দিকে তাকিয়ে তা করতে হবে তা বালালেন না। কেবল স্বর্গের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আর স্বর্গের যে চিত্রটি আঁকা হল তাতে, এখানে যা ভয়ঙ্কর বলে সাব্যস্ত, সেই ইন্দ্রিয় বিলাসেরই জয় জয়কার ঘোষিত হল।

তাই ইন্দ্রিয়-ভীতি সত্ত্বেও মানুষ ইন্দ্রিয়-সর্বস্বতার দিকে ঝুঁকলে – মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলবার মতো বড় কিছুর আশ্রয় খুঁজে পেলে না। নীতিবিদদের জানা উচিত ছিল, সংযম বলে কোন স্বাস্থ্য প্রদায়ী বস্তু নেই, আছে বড় জিনিষের জন্য প্রতীক্ষা আর সেই বড় জিনিষ হচ্ছে প্রেম। যে প্রেমে পড়েছে, অথবা প্রেমের মূল্য উপলব্ধি করেছে সে-ই প্রতীক্ষা করতে শিখেছে, অর্থাৎ সে-ই সহজে সংযমী হতে শিখেছে, অপরের পক্ষে সংযম মানে পীড়ন আর পীড়ন নিষ্ঠুরতার জনয়িত্রী।

যে বিনা কারণে নিজেকে দুঃখ দেয়, অপরকে দুঃখ দিতে তার তিলমাত্রও বাধে না। ঝধফরংস-এর গোড়ায় আত্মপীড়ন, একথা মনে রাখা চাই। ধার্মিক আর কালচার্ড মানুষে আরেকটা লক্ষ্যযোগ্য পার্থক্য এই যে, ধার্মিকের চেয়ে কালচার্ড মানুষের বন্ধন অনেক বেশী। উল্টা কথার মতো শোনালেও, কথাটি সত্য। ধার্মিকের কয়েকটি মোটা বন্ধন, সংস্কৃতিবান মানুষের বন্ধনের অন্ত নেই। অসংখ্য সূক্ষ্মচিন্তার বাঁধনে যে বাঁধা সেই তো ফ্রি-থিংকার আর ফ্রি থিংকিং কাচারের দান।

যেখানে ফ্রি থিংকিং নেই সেখানে কাচার নেই । প্রশ্ন হবে: ধর্ম আর কাচারকে যেভাবে আলাদা করে দেখা হল তাতে মনে হচ্ছে নাকি ধার্মিক কখনো প্রকৃত অর্থে কাচার্ড হতে পারে না? কিন্তু কথাটি কি সত্য? ধার্মিকদের মধ্যেও তো অনেক কাল্‌চার্ড লোক দেখতে পাওয়া যায়। উত্তরে বলব : তা বটে, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই টের পাওয়া যাবে, সেখানেও কাচারই কালচার্ড হওয়ার হেতু। অনুভূতি, কল্পনার সাধনা করেছেন বলেই তাঁরা কালচার্ড, অন্য কারণে নয়।

সংস্কৃতি মানে জীবনের Values সম্বন্ধে ধারণা। ধর্মের মতো মতবাদ বা আদর্শও তা ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই সে সম্বন্ধে সাবধান হওয়া দরকার। অতীতে ধর্ম ঈশ্বরকে আচ্ছন্ন করেছিল, বর্তমানে মতবাদ বা আদর্শ মনুষ্যত্বকে আচ্ছন্ন করতে পারে। লোকটা মোটের উপর ভালো কি মন্দ সেদিকে আমাদের নজর নেই, তার গায়ে কোন্ দলের মার্কা পড়েছে সেদিকেই আমাদের লক্ষ্য।

মার্কাটি নিজের দলের হলে তার সাতখুন মাফ, না হলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার দোষ বের করা আমাদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এই মনোবৃত্তি থেকে মুক্তি না পেলে কাল্‌চার্ড হওয়া যায় না। মনে রাখা দরকার, ধর্মের সমস্ত দোষ মতবাদের ঘাড়ে এসে চেপেছে। মতবাদী ধার্মিকের মতই অসহিষ্ণু ও সংকীর্ণ, ধার্মিকের মতোই দলবদ্ধতায় বিশ্বাসী, অধিকন্তু ধার্মিকের চেয়েও নিষ্ঠুর। ধার্মিকের নিষ্ঠুরতার সহায় ছিল ধর্মগ্রন্থের সমর্থন, মতবাদীর সহায় বিজ্ঞান।

আমি আমার জন্য নিষ্ঠুর হচ্ছি না, পৃথিবী-উন্নয়নের বিজ্ঞানসম্মত আদর্শের জন্যই নিষ্ঠুর হচ্ছি। অতএব এখানে আমার গৌরব নিহিত, কলঙ্ক নয়। নিষ্ঠুরতা ব্যাপারে এই যুক্তিই মতবাদীর আত্মসমর্থনের উপায়। সৌভাগ্যের বিষয় সত্যিকার সংস্কৃতিকামীরা কখনো মতবাদী হতে চায় না, মতবাদকে তারা যমের মত ভয় করে। কেননা তাদের কাজ বাইরের থেকে কোন দর্শন গ্রহণ করা নয়, বহু বেদনায় নিজের ভিতর থেকে একটা জীবনদর্শনের জন্ম দেওয়া, এবং দিনদিন তাকে উন্নতির পথে চালনা করা।

আইডিয়ার গোঁড়ামি থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় নিজের বা নিজের দলের অভ্রান্ততা সম্বন্ধে একটুখানি সন্দেহ রাখা। এই সন্দেহটুকুই মানুষকে সুন্দর করে তোলে, আর সৌন্দর্যই সংস্কৃতির লক্ষ্য। স্কেপটিসিজমের প্রভাব না থাকলে যে সভ্যতা সৃষ্টি হতে পারে না, এতো এক রকম অবিসংবাদিত সত্য। মনে রাখা দরকার, সংস্কৃতিবান হওয়ার কোন ধরাবাঁধা পথ নেই, বিচিত্র পথ।

কার জন্য কোন্ পথটি সার্থক কে বলবে? সেকালে বলা হত যত জীব, তত শিব; একালে বলা যেতে পারে যত সংস্কৃতিবান মানুষ তত সংস্কৃতি – · পন্থা। যে-পথটি ধরে মানুষ কালচার্ড হয় তা অলক্ষ্য না হলেও দুর্লক্ষ্য। তা পরে আবিষ্কার করা যায়, আগে নয়। তাই সংস্কৃতিবান মানুষটি একটা আলাদা মানুষ, স্বতন্ত্র-সত্তা। তার জীবনের একটি আলাদা স্বাদ, আলাদা ব্যঞ্জনা থাকে। সে মতবাদীর মতো বুলি আওড়ায় না। তার প্রতিকথায় আত্মা স্পন্দিত হয়ে – উঠে।

প্রেমের ব্যাপারে, সৌন্দর্যের ব্যাপারে, এমন কি সাধারণতা-ধর্মী কল্যাণের ব্যাপারেও তার আত্মার ঝকানি দেখতে পাওয়া যায়। নিজের পথটি নিজেই তৈরি করে নেয় বলে সে নিজেই নিজের নবী হয়ে দাঁড়ায়। তাই সে স্বাতন্ত্র্যধর্মী, গোলে হরিবোলের জগতে তার নিশ্বাস বন্ধ আসে। কল্যাণের ব্যাপারে সাম্যকে স্বীকার করলেও প্রেমের ব্যাপারে, সৌন্দর্যের ব্যাপারে, চিন্তার ব্যাপারে সে স্বাতন্ত্র্য তথা বৈচিত্র্যের পক্ষপাতী।

সত্যকার সংস্কৃতিকামীরা নিজেদের ছাঁচে ঢালাই করতে চায় না। নকল যীশু, নকল বুদ্ধ, নকল মার্কস বা নকল লেনিন হওয়া তাদের মনঃপূত নয়। ক্ষুদ্র হলেও তারা খাঁটি কিছু হতে চায়। কিন্তু পথের বিভিন্নতা থাকলেও তাদের লক্ষ্যের সাম্য রয়েছে — – সকলেই অমৃত তথা আত্মাকে চায়। যীশুখৃষ্ট যখন বলেন: For what is man profited if he shall gain the whole word, and lose his own soul ?— তখন সংস্কৃতিকামীর অন্তরের কথাই বলেন।

এই খ্রিষ্টবাণীরই ঔপনিষদিক ভাবান্তর হচ্ছে ‘যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম’ – যা দিয়ে আমি অমৃত লাভ করবনা তা দিয়ে আমি কি করব? অমৃতকে কামনা, তথা প্রেমকে কামনা, সৌন্দর্যকে কামনা, উচ্চতর জীবনকে কামনা, এই তো সংস্কৃতি। এই জন্য সংস্কৃতিকে একটা আলাদা ধর্ম, উচ্চস্তরের ধর্ম বলা হয়েছে। প্রাণী-জীবনের ঊর্ধ্বে যে জীবন রয়েছে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়ে, এবং তারমারা প্রাণী-জীবনকে মন্ডিত করে দিয়ে, তা মানুষের অন্তরে মুক্তির স্বাদ নিয়ে আসে।

তাই বলে প্রাণী-জীবনের তথা ক্ষুৎপিপাসার মূল্য যে তা দেয় না তা নয়। খুবই দেয়। Man does not live by bread alone এই কথাটার মধ্যেই ক্ষুৎপিপাসার স্বীকৃতি রয়েছে। তবে মর্যাদাভেদ আছে। যা নিয়ে বাঁচা যায়, আর যার জন্য বাঁচতে হয়, তা কখনো এক মর্যাদা পেতে পারে না। তাই সংস্কৃতিকামীদের ইচ্ছা: ক্ষুৎপিপাসার জগটি তৈরি করা হোক ক্ষুৎপিপাসার ঊর্ধ্বে যে জগৎটি রয়েছে তারি পানে লক্ষ্য রেখে।

নইলে সংস্কৃতি ব্যাহত হবে। সংস্কৃতিকামীরা আরো কামনা করে: ক্ষুৎপিপাসার জগৎ তথা কল্যাণের জগৎ নির্মাণে লক্ষ্যের চেয়ে উপায়কে যেন কম বড় স্থান দেওয়া না হয়। কেননা উপায়ই চরিত্রের স্রষ্টা- লক্ষ্য নয়।

 

সংস্কৃতি কথা ২

 

শব্দার্থ ও টীকা

ইন্দ্রিয় সাধনা— যে সকল দেহ-যন্ত্র বা শক্তিদ্বারা বাহ্য বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান বা বিভিন্ন ক্রিয়াসম্পাদনে সামর্থ্য জন্মে তার সাধনা। ইন্দ্রিয় চৌদ্দটি। যথা: বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ — এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়; চক্ষু, কর্ণ, নাসা, জিহ্বা, ত্বক – এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়; মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, চিত্ত— এই চারটি অন্তরিন্দ্রয় ।

পঞ্চপ্রদীপ— পাঁচটি মুখ বিশিষ্ট প্রদীপ। সাধারণত আরতি করতে ব্যবহৃত হয়।

ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে জীবনসাধনা — চক্ষু কর্ণ নাসা জিহ্বা ত্বক এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটিকে যথাযথ
ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী হয়ে জীবন পরিচালনা। ঐশ্বর্য ঈশ্বরত্ব, প্রভুত্ব; যোগলব্ধ শক্তি, বিভূতি। শব্দটি গঠিত হয়েছে এভাবে – সং.ঈশ্বর+য (ভা)।

শ্রী— সৌন্দর্য, লাবণ্য, শোভা ।

হী— লজ্জা।

তপস্বিনী— যে নারী সংসার ত্যাগ করে (অরণ্যবাসী হয়ে) কঠোর নিয়মে দেবতার আরাধনা করেন।

উন্মেষশালিনী— উন্মীলনকারিণী, উদ্রেককারিণী।

জনয়িত্রী— জন্মদাত্রী, জননী, মাতা। Sadism— ধর্ষকাম; নিষ্ঠুরতায় যে যৌন আনন্দলাভ হয়; Sexual delight in cruelty.

স্কেপটিসিজম— আত্মমুক্তির মতবাদ।

শিল্পোদর পরায়ণ— কামপ্রবৃত্তি ও উদরের তৃপ্তিই যার একমাত্র লক্ষ্য ।

অর্থগৃধু— অর্থলোভী।

বস্তুসংক্ষেপ

জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মধ্যে মানুষের চোখ ও কান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সংস্কৃতি বা কালচার এই দুয়ের বিকাশ ঘটাতে চাইলেও ধর্ম তা অনুমোদন করে না। ধর্ম বরং সত্যদর্শন ও যুক্তি শ্রবণকে সংযমের কথা বলে বাধা দেয়। সংস্কৃতিবান মানুষ কিন্তু সত্যদর্শন ও যুক্তির আলোকে এগিয়ে যান। মানব সমাজের অর্ধাংশ নারীকে সংস্কৃতি অবজ্ঞা করতে চায় না। বরং নারী কালচারের অপরিহার্য উপাদান। কেননা, সুর ও সৌন্দর্যের অন্যতম উৎস হলো নারী। নারীতে কাম আছে সন্দেহ নেই।

কিন্তু কামের চেয়ে প্রেম, ভোগের চেয়ে উপভোগই সংস্কৃতিবান মানুষের কাছে অন্বিষ্ট। অথচ, নারীকে নরকেরলার হিসেবে চিহ্নিত করে ধর্ম। সমাজও মূল্যবোধ রক্ষার নামে নারীব্যক্তিত্ব বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে। অজানাকে জানা, নিষিদ্ধকে জয় করা মানুষের সহজাত আকাঙ্ক্ষা। যেহেতু ধর্ম নারীর মধ্যে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তাই পুরুষ নারীভোগে এতোটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে; যাতে সমাজ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে।

কিন্তু উচিত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বিকাশের মাধ্যমে পুরুষ ও নারীর উপর আরোপিত পরস্পর বিরোধী সম্পর্ককে সহজতর করে তোলা। ধার্মিক ও মতবাদীদের মধ্যে পার্থক্য নেই । কেননা, তারা উভয়েই মনে করেন যে, ,নিজ নিজ ধর্ম বা মতবাদ অভ্রান্ত আর বাকী সব মিথ্যা। কিন্তু সংস্কৃতিবান মানুষ প্রজ্ঞা ও যুক্তিরারা পরমত বিশেষণ করে সেখানে সভ্যতার প্রগতিমুখীনতা অনুসন্ধান করেন।

সে দিক থেকে কালচার্ড মানুষ ধার্মিক ও মতবাদী যে-কারো চেয়ে যথেষ্ট গোঁড়ামিমুক্ত হন। প্রেমের সাধনার মাধ্যমে অর্জিত হয় সুসংস্কৃতি এবং ব্যক্তিমাত্রই স্বতন্ত্র পথে এ গন্তব্যে পৌঁছুতে পারেন। সৌন্দর্য, সত্য আর জ্ঞানের পথে প্রেমের সাধনাই এখানে প্রথম এবং প্রধান। কালচার্ড মানুষ তাই ক্ষুৎপিপাসা নিবৃত্তির জন্যে বাঁচেন না, মহত্তর জীবন যাপনের জন্যে খাদ্যাহার গ্রহণ করেন। প্রগতি ও সভ্যতা এক নয় – – যদিও অনেকেই অভিন্ন মনে করেন।

উৎপাদনের সঙ্গে প্রগতির সংশ্লিষ্টতা; এখানে সৌন্দর্য ও কল্যাণের সম্পর্ক অত্যাবশ্যকীয় নয়। কিন্তু সভ্যতা হলো প্রগতির সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে সৌন্দর্য ও কল্যাণের সমন্বয়, উপরন্তু প্রেমের যথাযথ সংশেষ। কালচার্ড মানুষ স্বভাবতই সভ্যতাকামী হন। তবে সভ্যতার পাশাপাশি মূল্যবোধের ব্যাপ্তি জরুরি। মূল্যবোধের সুদৃঢ় ভিত্তির উপর ভর করে মানুষের সংস্কার মুক্তি ঘটে থাকে।

সংস্কার মুক্তি অর্থ যথেচ্ছাচার নয়। অবাধ যৌনাচার তাই কালচার্ড মানুষের কাম্য হতে পারে না। কামনার স্থূলত্ব নয়, প্রেমের মহত্ত্বই সংস্কৃতিবান মানুষের কাছে বড়। মানুষ সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে পরিপূর্ণ বা ত্রঢ়ব হন। তিনি মহৎ, সুন্দর ও যথাযথভাবে বেঁচে থাকেন বিবেক জাগ্রত করে — প্রেমময় হয়ে ।

পাঠোত্তর মূল্যায়ন

সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের উত্তর লিখুন

১. “ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপক জ্বেলে জীবনসাধনা’ বলতে লেখক কি বুঝিয়েছেন?

২. নারী কালচারের অপরিহার্য উপাদান কেন? ৩. সভ্যতা বলতে এখানে কি বুঝানো হয়েছে?

৪. মানুষের সংস্কারমুক্তি ঘটে কিভাবে?

২ নং সংক্ষিপ্ত-উত্তর প্রশ্নের নমুনা-উত্তর

মনুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের স্বাধীনতা ও নবজন্মদানের ব্যাপারে কালচার সর্বাপেক্ষা অধিক উৎসাহ প্রদান করে। নারী এই ইন্দ্রিয় সাধনার জাগরণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। নারীর চোখ-মুখ, স্নেহ-প্রীতি, সৌন্দর্য ও লজ্জা নিয়েই শিল্প-সাহিত্যের কারবার। আর এই শিল্প-সাহিত্যই হলো কালচারের বাহন। মানুষের, বিশেষত পুরুষের সুশীলবোধ নারীর সান্নিধ্যেই জাগ্রত হয় এবং জীবনে শক্তি সাহস ও প্রেরণা লাভ করে।

মানসিক সমৃদ্ধি আর সাংসারিক সর্বপ্রকার অগ্রবর্তিতার মূলেও হলো নারী। কালচার যেহেতু মানুষের মনোজাগতিক উন্নয়নের মাধ্যমে তার মধ্যে প্রেম-আনন্দ ও ন্যায়বোধের সৃষ্টি করে সেহেতু নারী কালচারের অপরিহার্য উপাদান হয়ে ওঠে।

প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করুন

১. সংস্কৃতি মানেই আত্মনিয়ন্ত্রণ – নিজের আইনে নিজেকে বাঁধা।

২. যদি বলা হত প্রেম ভালো, আনন্দ ভালো, প্রেমের জন্যে প্রতীক্ষা ভালো, আনন্দের জন্য প্রতীক্ষা ভালো, তাহলে পৃথিবীর চেহারা হয়তো এতো কদর্য হতো না। ।

৩. অমৃতকে কামনা, তথা প্রেমকে কামনা, সৌন্দর্যকে কামনা, উচ্চতর জীবনকে কামনা, এইতো সংস্কৃতি

৪. জ্ঞানের ক্ষেত্রেই পরিবর্তনশীলতা অবধারিত, সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে নয়।

৫. বাঁচা, বাঁচা, বাঁচা। প্রচুরভাবে গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।

৩ নং ব্যাখ্যার নমুনা-উত্তর

আলোচ্য অংশটুকু মোতাহের হোসেন চৌধুরী রচিত ‘সংস্কৃতি-কথা’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে। এখানে সংস্কৃতি সাধনায় প্রার্থিত উপাদান সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্কৃতি ব্যক্তিমনকে বিকশিত করে ও মুক্তি দেয়। ধর্ম যেখানে অবিশ্বাসীদের উপর নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে, মতবাদ যেখানে পরমত সহ্য ও স্বীকার করে না, সেখানে সংস্কৃতি সত্যদর্শন ও মুক্তির আলোকে অন্যকে মেনে নেয়।

প্রেম ও সৌন্দর্যই একজন সংস্কৃতিবানের কাছে বড়ো। উচ্চতর জীবন গড়ার লক্ষ্যে মনুষ্যত্ব ও মূল্যবোধ অর্জন প্রধান হয়ে ওঠে তার সামনে। সংস্কৃতি মানুষকে ‘মানুষ’ ভাবতে শেখায়। কারণ জ্ঞানেন্দ্রিয় সাধনায় প্রেম ও সৌন্দর্য তার সামনে বড় হয়ে ওঠে। এই প্রেম ও সৌন্দর্যের আলোকে উচ্চতর জীবনের সোপান তৈরি করে সংস্কৃতি।

 

সংস্কৃতি কথা ২

 

রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর লিখুন

১. মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য বিবৃত করুন।

২. ধার্মিক ও মতবাদীদের সঙ্গে কালচার্ড মানুষের পার্থক্য কোথায়? ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধের অনুসরণে লিখুন ।

৩. মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধ অবলম্বনে সংস্কৃতির সংজ্ঞা প্রদান করুন।

৪. ‘সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎ ভাবে বাঁচা — আলোচনা করুন।

Leave a Comment